ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

নীল জলের মায়াবী লেক

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

১৯৪০ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতকে নির্মাণ করা হয় ‘আসাম বাংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি’। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ করে এর চাহিদা মেটানো হতো। বিভিন্ন সমস্যার কারণে ভারত থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেলে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখতে ১৯৬০ সালে তাহিরপুর সীমান্তের টেকেরঘাটে জরিপ চালানো হয়। ৩২৭ একর ভূমির উপর জরিপ চালিয়ে চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৬ সাল থেকে খনিজ প্রকল্প চালু করে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয় এখান থেকে। এই খনিজ ভূমির অনেকটাজুড়ে ছিল লেক।

১৯৯৬ সালে প্রকল্পটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকেই টেকেরঘাট চুনাপথরের পরিত্যাক্ত খনির লাইমস্টোন লেক অলস পড়ে থাকে। নীল রঙের পানি থাকায় এই লেক ‘নীলাদ্রি লেক’ হিসেবেও পরিচিতি পায়। যদিও লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। অবশ্য স্থানীয় লোকজন একে ‘টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি’ নামে চেনে।

ইতিহাস থেকে কথাগুলো বলছিলেন সহকর্মী মুসা ভাই। মঙ্গলবার অফিসে কিছুটা কাজের চাপ কম, কথা হচ্ছিল আসছে সপ্তাহে নতুন কোথায় যাওয়া যায়? মুসা ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম- আসছে সপ্তাহে মিশন হবে নীলাদ্রি লেক।

সপ্তাহান্তে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সকাল হতেই তৈরি হয়ে নিলাম। ফোন দিলাম মুসা ভাইকে- আমি তৈরি হয়ে গেছি, কোথায় আসতে হবে? তিনি বললেন, নীলাদ্রি লেকে যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ। সেখানে থেকে বাকি পথ মটরসাইকেলে যেতে হবে। কিন্তু সুনামগঞ্জ যাবো কীভাবে?

মুসা ভাই বললেন, আপনি চৌহাট্টা আসেন। সেখান থেকে সুনামগঞ্জ যাবার পরিবহন পাওয়া যাবে। কথা মতো আমি উপস্থিত হলাম চৌহাট্টায়, অপেক্ষা করতে লাগলাম মুসা ভাইয়ের। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি উপস্থিত। আমরা চার চাকার যানে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জ পানে।

দিবসের প্রথম প্রহর, যে কারণে সূর্যদেবের প্রভাব এখনো তেমন পড়েনি। আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট পেড়িয়ে আমরা চললাম এগিয়ে। শীতের শেষ, বর্ষার শুরু- গাছে গাছে নতুন পাতা ডানা মেলেছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ শহরে। সেই কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছি, পেটে দানাপানি পরে নাই। সাইনবোর্ড বিহীন একটা হোটেলে সকালের নাস্তা করে নিলাম। মন খুব ভালো লাগছিল, কিছু সময়ের মধ্যে হয়তো আমরা পৌঁছে যাবো গন্তব্যে।

সেই আনন্দে জল ঢেলে দিয়ে মুসা ভাই জানালেন, ধুলোমাখা পথে এক ঘণ্টার একটা মোটরসাইকেল জার্নি তখনো বাকি। কী আর করা! গাড়ি থেকে নেমে রিকশায় উঠলাম। যাব এম এ খান সেতুতে। ওখানে ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। সেতুর পথে যাওয়ার সময় দেখা মিলল সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে মোটরবাইকের পাশাপাশি সিএনজিও পাওয়া যায়। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য ভালোভাবে দেখার সুযোগ নষ্ট করতে চাইলাম না। আমাদের পাইলট, থুক্কু মোটরসাইকেল চালকের নাম দেলোয়ার। বেশ স্মার্ট ছেলে, চোখে সানগ্লাস। প্রথমদিকে কিছুক্ষণ পরপর ছবি তোলার জন্য তাকে থামতে হচ্ছিল। ভাবলাম বিরক্ত হচ্ছে। ছবি তোলার চিন্তা বাদ দিলাম। খানিক পর দেলোয়ার নিজে থেকেই বলে বসল, ‘ভাইজান, এইটা তোলেন। ভাইজান, ওইটা তোলেন।’

আবার শুরু হলো ছবি তোলা। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছালাম জাদুকাটা নদীর তীরে। অসাধারণ রূপ জাদুকাটা নদীর! জাদুকাটা পাড়ি দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা চলে এলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য নীলাদ্রি লেকের কাছে। লেকের কাছে গিয়ে চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না- নীল রঙে সে কীভাবে সেজে আছে! এ যেন নীলের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া!

আমরা পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম। মাঝের টিলাগুলো আর ওপাড়ের পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশের শেষ সীমানা। বড় উঁচু পাহাড়টিতেই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে। এই লেকটি এক সময় চুনাপাথরের কারখানার কাঁচামাল সাপ্লাইয়ের ভাণ্ডার ছিল; যা এখন বিলীন। আরেকটা কথা বলা হলো না- এই লেকের মূল নাম শহীদ সিরাজ লেক কীভাবে হলো? মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ৫ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সাব সেক্টর ছিল টেকেরঘাট। মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন এই সাব সেক্টরের কমান্ডার।  সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হলে তাঁকে কবর দেওয়া হয় টেকেরঘাটে। তাই এককালের চুনাপাথরের খনি, যখন লেকে পরিণত হয়, তখন এর নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ লেক। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এই কমান্ডারকে বীরবিক্রম উপাধীতে ভূষিত করা হয়েছিল। লেকের পাড়েই আছে শহীদ সিরাজের সমাধি।

আমরা চলছি এগিয়ে; পাশেই আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের সীমানা। যারা যাবেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে সীমান্ত এলাকার কারণে আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে। সীমানার খুব কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। সাঁতার না জানলে লেকের পানিতে না নামাই ভালো। নামলেও বেশি দূরে যাবেন না। কারণ এখান থেকে প্রচুর চুনাপাথর উত্তোলন করা হতো। ফলে লেক বেশ গভীর।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাস যায় সুনামগঞ্জ; ভাড়া ৫৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে নতুন ব্রিজ পার হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে হবে। চাইলে টেকেরঘাট পর্যন্ত সরাসরি মোটরসাইকেল রিজার্ভ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ভাড়া ৩০০ টাকা। মাঝপথে যাদুকাটা নদী পার হতে জনপ্রতি ভাড়া ৫ টাকা। মোটরসাইকেলের ভাড়া ২০ টাকা। এছাড়া আপনি সুনামগঞ্জ থেকে লাউড়ের গড় পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যেতে পারেন। ভাড়া ২০০ টাকা। তারপর যাদুকাটা নদী পাড় হয়ে বারেক টিলা থেকে ১২০ টাকা ভাড়ায় টেকেরঘাট যেতে পারবেন। 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়