ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

২০ গুচ্ছ এলাকায় উৎপাদন হচ্ছে রফতানিযোগ্য আম

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:২৩, ১৭ মে ২০২৩  

২০ গুচ্ছ এলাকায় উৎপাদন হচ্ছে রফতানিযোগ্য আম

২০ গুচ্ছ এলাকায় উৎপাদন হচ্ছে রফতানিযোগ্য আম

দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত আমের পরিমাণ প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রফতানি হয় মাত্র দেড় হাজার টনের মতো। মূলত রফতানি উপযোগী না হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা এ ফল কিনতে আগ্রহ দেখায় না। চলতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে ছয় জেলার নয়টি উপজেলায় মোট ২০টি গুচ্ছ এলাকায় (ক্লাস্টার) রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেলে এর বেশির ভাগই রফতানি করা যাবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের অধীনে ২০টি গুচ্ছ এলাকার মধ্যে সাতক্ষীরা সদর ও কলারোয়া, মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর, যশোরের শার্শা, রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এবং নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় একটি করে নয়টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। এসব উপজেলার বাগানে আম উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে মনিটরিং করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। পাশাপাশি বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও মনিটরিং করা হয়। এর বাইরে বাকি ১১টি গুচ্ছ এলাকা অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে মনিটরিং করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহীর বাঘায় চারটি, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় দুটি, যশোরের শার্শায় একটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে দুটি ও নওগাঁর সাপাহারে দুটি রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। মূলত এসব বাগানের আকার বড় এবং দাগমুক্ত আম রফতানির জন্য রফতানিকারকরা কৃষকদের থেকে কেনেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০টি গুচ্ছ এলাকায় ৩০৪ জন কৃষকের আমবাগান রয়েছে। এর আয়তন প্রায় ২ হাজার ১৩৩ একর। বাগানগুলোয় এ বছর ১২ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

ডিএইর কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর সারা দেশে আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদন হতে পারে। গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ টন। আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) উৎপাদন হয় ২৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে এর মধ্যে খুব অল্প পরিমাণে রফতানি হয়।

ডিএই সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮টি দেশে ১ হাজার ৭৫৭ টন আম রফতানি হয়। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬৪২ টন, সৌদি আরবে ২২৬, কাতারে ১৬১, ইতালিতে ১৭৩ ও কুয়েতে ১৪৯ টন রফতানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৮৮ টন আম রফতানি হয়েছিল। আগের বছর রফতানির পরিমাণ ছিল ২৮৩ টন।

নওগাঁর সাপাহারে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য এবার ৫৫২ একরের একটি গুচ্ছ এলাকা তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলে ৩৫ কৃষকের বাগান রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩০৬ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। সাপাহার উপজেলার চাষী সোহেল রানার ১৫০ বিঘা জমিতে আমবাগান রয়েছে। প্রায় ২০ হাজার গাছের এ বাগানে আম্রপালি, বারি-৪, বেনানামতি, গোলমতি ও কাটিমন জাতের আমগাছ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বছর আড়াইশ টন আম উৎপাদন হবে। এর মধ্যে ৫০ টন রফতানির টার্গেট রয়েছে। রফতানিকারকরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। গোলমতি আম আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। এখন পর্যন্ত আমের অবস্থা ভালো। যেখানে পানির ব্যবস্থা যথাযথ সেখানে আমের আকার ভালো হয়েছে। সরকারিভাবে ৫০ শতক জমির জন্য সার, কীটনাশক ও ফ্রুট ব্যাগিংয়ের সহায়তা দেয়া হয়েছে। তারা নিয়মিত মনিটরিং ও পরামর্শ দিচ্ছেন।’

নওগাঁয় এ বছর ৩০ হাজার হেক্টর জমির আমবাগান থেকে ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর নওগাঁ থেকে ৭৭ টন আম রফতানি হয়। এ বছর ৩০০ টন রফতানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

জেলা ডিএইর উপপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নওগাঁয় কৃষকদের আম উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা চমত্কার। আশা করি এবার ভালো পরিমাণে আম রফতানি হবে। মূলত এ অঞ্চল থেকে আম্রপালি ও বারি-৪ জাতের আম রফতানি বেশি হয়।’

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় ৩৯ কৃষকের বাগানের সমন্বয়ে একটি গুচ্ছ এলাকা তৈরি করা হয়েছে। ১২৯ একর জমিতে চলতি বছর ৯০৭ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কলারোয়ার ইলিশপুর গ্রামের কৃষক কবিরুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘এবার স্মরণকালের সবচেয়ে ভালো ফলন হয়েছে। তবে আমের আকার কিছুটা ছোট। আমার ২৯ বিঘা জমিতে প্রায় এক হাজার গাছ রয়েছে। এর মধ্যে আম্রপালি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোবিন্দভোগ জাতের আম রয়েছে বাগানে।’

কলারোয়া উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মৃণাল কান্তি মণ্ডল বলেন, ‘কলারোয়া ক্লাস্টারে এবার রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন ভালো হয়েছে। উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) মেনে কীভাবে উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া জৈব, বালাইনাশক থেকে শুরু করে আম পরিবহনের জন্য ক্যারেটসহ যাবতীয় সবকিছু প্রদান করেছি। এছাড়া এসবের ব্যবহারেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শুরুর দিকে বৃষ্টি ও কালবৈশাখীর কারণে আমে কিছুটা বাদামি রঙ হয়ে গেছে। আবার আকারেও কিছুটা ছোট, যা রফতানির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। কারণ রফতানি করতে হলে একেবারে ফ্রেশ আম প্রয়োজন। ৩০ শতাংশের মতো ফ্রেশ আম পাওয়া যাবে।’

সাতক্ষীরা জেলা ডিএইর উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় এবার আমের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু শুরুর বৃষ্টির কারণে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় ফলন ভালো। আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে, যাতে কৃষকরা ভালো দাম পান।’

ডিএই বলছে, দেশের আম রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাজ্য। মোট রফতানির প্রায় ৪০ শতাংশই এ দেশে রফতানি হয়। আরো কয়েকটি দেশে অল্প পরিমাণে রফতানি হলেও বড় পরিসরে ২৩ মে শুরু হবে আম রফতানি। এদিন রফতানিকারকরা যুক্তরাজ্যের বাজারে আম রফতানি শুরু করবেন। তবে বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা ও সরকারিভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই রফতানি বাড়ানো যাবে বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেলে এবার চার হাজার টন আম রফতানি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়কে আম রফতানির বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক সহায়তা করছি। আমাদের যে ক্লাস্টারগুলো রয়েছে, সেখানে আমরা নিয়মিত মনিটরিং করেছি। রফতানির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। আমাদের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমরা আম পাঠাতে পারি না। কার্গো স্পেস পাওয়া যায় না। স্পেশালভাবে কার্গো দেয়া হয় না। রফতানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ আলাদাভাবে কার্গো সুবিধা দেয়। এ কারণে তারা বেশি পরিমাণ রফতানি করতে পারে। ভারতের চেয়ে আমাদের দাম ১৬-২০ টাকা কেজিতে বেড়ে যায় শুধু বড়তি পরিবহন খরচের কারণে। আবার কার্গোয় কোল্ড স্টোরেজের সুবিধা পাওয়া যায় না। আমাদের দৈনিক ৩০০-৪০০ টনের চাহিদা থাকলেও মাত্র ৮-১০ টনের সুযোগ দেয়া হয়। রফতানি বাড়াতে হলে এসব সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।’

ডিএইর রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে আবহাওয়া রয়েছে এমন থাকলে ভালো পরিমাণ আম রফতানি করা সম্ভব হবে। একেবারে পরিপক্বতা না এলে আমরা রফতানি করতে নিষেধ করছি। কারণ একবার বাজার নষ্ট হয়ে গেলে পরে সেটি ধরা যাবে না। গত বছরের তুলনায় আমাদের এবার দ্বিগুণ আম রফতানির পরিকল্পনা রয়েছে। সেজন্য ক্লাস্টার করে কৃষকদের সহযোগিতা করা হয়েছে। পাশাপাশি মনিটরিং করেছি যেন উত্তম কৃষিচর্চা মেনে আম উৎপাদন হয়। সেক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশের আমের বাজার প্রসারিত হবে।’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়