ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হজ পালনে জরুরীভাবে যা জানা একান্ত প্রয়োজন

ইসলাম ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ৬ জুন ২০২২  

সংগৃহীত

সংগৃহীত

মুসলিম উম্মাহর সর্বোত্তম ইবাদত হজ। অর্থ ছাড়া যেমন হজ হয় না আবার হজ পালনে রয়েছে অনেক নিয়ম। এ হজ তিনভাবে আদায় করা যায়। তাহলো- এক ইহরামে শুধু হজ (ইফরাদ), এক ইহরামে হজ ও ওমরাহ (কেরান), আলাদা ইহরামে হজ ও ওমরাহ (তামাত্তু)।

বাংলাদেশী অধিকাংশ হজযাত্রী তামাত্তু হজ সম্পাদন করে থাকেন। অর্থাৎ আলাদা আলাদা ইহরামে ওমরাহ ও হজ করেন। প্রথমে ওমরাহ করেন, পরে আবারো ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদন করেন। তামাত্তু হজ সম্পাদনের নিয়ম ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো-

ধারাবাহিকভাবে হজ সম্পাদনের নিয়ম

তামাত্তু হজ পালনকারীরা হজের মাসগুলোতে (শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ) হজের সফরে প্রথমেই ওমরা পালন করবেন। এরপর ওমরার ইহরাম থেকে মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে হালাল হয়ে যাবেন। হজের নির্ধারিত সময় আসার আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবে; স্বাভাবিক পোশাকে চলাফেরা করবেন।

হজের নির্ধারিত সময় ৭ থেকে ৯ জিলহজের মধ্যে হজের জন্য পুনরায় ইহরাম বেঁধে হজ সম্পাদন করাই হলো তামাত্তু হজ। এ হজে কষ্ট কম এবং সহজ।

১. ওমরার ইহরাম (ফরজ)

যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি মক্কায় যান, তারা নিজেদের ঘর থেকেই ইহরাম করে রওয়ানা হতে পারবেন। অথবা নিজ নিজ দেশের হজ ক্যাম্প থেকে অথবা মিকাত অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধবেন।

ইহরাম বাঁধার জন্য ওজু বা গোসল করা। এরপর মিকাত পার হওয়ার আগেই পুরুষ হজ ওমরা পালনকারীরা দুটি সেলাইবিহীন কাপড় পরবে। আর মহিলারা তাদের ইহরামের পোশাক পরবে।

এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে এভাবে ওমরার নিয়ত করা-

‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ওমরাতান।’

এরপর তিনবার তালবিয়া পাঠ করা-

তালবিয়া

i) لَبَّيْكَ ا للّهُمَّ لَبَّيْكَ

ii) لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ

iii)     اِنَّ الْحَمدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ

iv) لاَ شَرِيْكَ لَكَ

তালবিয়ার উচ্চারণ

১. ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,

২. লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,

৩. ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক্‌,

৪. লা শারিকা লাক।’

তালবিয়ার অর্থ

১. ‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত!

২. আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই।

৩. নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার।

৪. আপনার কোনো অংশীদার নেই।’

২. ওমরার তাওয়াফ (ওয়াজিব)

কাবা শরিফকে ওজুর সঙ্গে ৭ প্রদক্ষিণে তাওয়াফ সম্পন্ন করা। হাজরে আসওয়াদ থেকে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত ওঠিয়ে তাওয়াফ শুরু করা।

সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা অথবা হাতে স্পর্শ করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে দু’হাত কাঁধ পর্যন্ত ওঠিয়ে হতাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা। সম্ভব হলে রুকনে ইয়ামেনি অতিক্রম করার সময় তা স্পর্শ করা। সম্ভব না হলে ইশারা করাই যথেষ্ট।

> ইজতিবা করা

বাইতুল্লাহ তাওয়াফকালে অবশ্যই ইজতিবা করা। ইজতিবা হলো ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচে রেখে চাদরের দুই মাথাকে বাম কাঁধের সামনে ও পিছনে ফেলে রাখা।

> রমল করা

প্রথম তিন চক্কর রমল তথা বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদমে দ্রুতগতিতে প্রদক্ষিণ করা। পরবর্তী চার চক্কর সাধারণভাবে হেটে তাওয়াফ সম্পন্ন করা।

কাবা শরিফ তাওয়াফে রুকনে ইয়ামেনি থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত তাওয়াফকালে এ দোয়া পড়া।

রাব্বানা আতিনা ফিদ্দিুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আ’জাবান নার।’

অতঃপর হাজরে আসওয়াদে এসে এভাবে সাতবার চক্কর বা প্রদক্ষিণ ও আট ইস্তিলামে তাওয়াফ শেষ করা।।

৩. মাকামে ইবরাহিমে নামাজ (ওয়াজিব)

তাওয়াফ শেষ হলে ভিড় না থাকলে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে দোয়া করা। ভিড় থাকলে সরে গিয়ে দূরে নামাজ আদায় করা। এটা দোয়া কবুলের স্থান। এরপর দাঁড়িয়ে ঝমঝমের পানি পান করা।

৪. ওমরার সায়ী (ওয়াজিব)

সাফা পাহাড়ের ওপরে আরোহন করে সেখান থেকে ক্বিবলামুখী হয়ে সায়ীর নিয়ত করে সাফা হতে সায়ী শুরু করা। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী নির্ধারিত চিহ্নিত স্থান দ্রুতবেগে অতিক্রম করা। মারাওয়া পাহাড়ে আরোহন করে দোয়া করা। এরপর আবার সাফায় আসা। এভাবে সাতবার সায়ী করা।

৫. মাথা মুণ্ডানো (ওয়াজিব)

পুরুষ হলে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসারে সম্পূর্ণ মাথা মুণ্ডণ করা বা চুল ছাঁটা। মহিলা হলে চুলের মাথার এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ওমরার ইহরাম থেকে বের হওয়া। মনে রাখতে হবে, মহিলাদের চুল কাটবে মুহরিম ব্যক্তি।

ওমরা পালন শেষে ইহরাম থেকে পবিত্র হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন ও চলাফেরা করা। এরপর হজের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ৭ জিলহজ থেকে আবার হজের জন্য ইহরাম বাঁধা।

হজের ধারাবাহিক কাজ

১. হজের ইহরাম (ফরজ)

কাবা শরিফে ৭ জিলহজ হজের নিয়মাবলীর ওপর খুতবা দেয়া হয়। তা মনোযোগ সহকারে শোনা। অতঃপর হারাম শরিফ বা বাসা থেকে আগের নিয়মে শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে ৮ জিলহজ জোহরের নামাজের পূর্বে মিনায় পৌঁছা।

২. মিনায় অবস্থান (সুন্নাত)

৮ জিলহজ জোহর থেকে ৯ জিলহজ ফজর পর্যন্ত মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা এবং সেখানে অবস্থান করা।

৩. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (ফরজ)

হজের অন্যতম রুকন হলো আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। ৯ জিলহজ সকালে মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করে আরাফায় আসার প্রস্তুতিস্বরূপ গোসল করে একবার তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা-

‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

জোহরের নামাজের আগেই আরাফায় এসে উপস্থিত হওয়া। অতঃপর দুপুরের পর থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে হজের খুতবা শোনা। নিজ নিজ তাবুতে জোহর ও আসরের নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে আলাদাভাবে আদায় করা। সুর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়ে মুজদালিফার দিকে রওয়ানা হওয়া।

৪. মুজদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব)

আরাফাতের ময়দান থেকে সুর্যাস্তের পর মুজদালিফায় গিয়ে ইশার সময় মাগরিব ও ইশা এক আজানে ও একই ইক্বামাতে একসঙ্গে আদায় করা।

প্রত্যেক নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক আদায় করা অর্থাৎ ১৩ জিলহজ আসর নামাজ পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক আদায় করা।

মুজদালিফায় রাতযাপন করা সুন্নাত। আর ফজরের নামাজের পর থেকে সুর্য ওঠার আগ পর্যন্ত কিছু সময় অবস্থান করা ওয়াজিব। সুতরাং ফজরের আগে মুজদালিফা ত্যাগ করা যাবে না। তবে সুর্য ওঠার আগেই মুজদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হতে হবে।

মুজদালিফা থেকে মিনায় আসার সময় মিনায় নিক্ষেপের জন্য ৭০টি ছোট ছোট কংকর সংগ্রহ করে নেওয়া।

৫. কংকর নিক্ষেপ (প্রথম দিন)

১০ জিলহজ ফজর নামাজ মুজদালিফায় আদায় করে সূর্য ওঠার আগে মিনায় এসে বড় জামরায় ৭টি (সাত) কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। এ দিন সম্ভব না হলে রাতের শেষ পর্যন্ত সময়ে কংকর নিক্ষেপ করা। কংকর নিক্ষেপের জায়গায় বাংলায় দিক-নির্দেশনা দেয়া হয় তা মনোযোগ সহকারে শোনা।

৬. কোরবানি করা (ওয়াজিব)

বড় শয়তানকে পাথর মেরে কুরবানি করা।

৭. মাথা মুণ্ডন (ওয়াজিব)

কুরবানি সম্পন্ন করার পর মাথা হলক বা মুণ্ডন করা বিশ্ব নবির আদর্শের অনুসরণ। যা ওয়াজিব। মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে সে ইহরামের পোশাক ছেড়ে অন্যকাপড় পরিধানসহ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে। তবে স্ত্রী সহবাস করা যাবে না।

সতর্কতা

১০ জিলহজ বড় শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ, কুরবানি ও মাথা মুণ্ডন- এ তিন কাজের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি।

৮. তাওয়াফে জিয়ারাত (ফরজ)

হজের সর্বশেষ ফরজ কাজ তাওয়াফে জিয়ারাত। যা ১২ জিলহজ সুর্যাস্তের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। তবে ১২ তারিখের পর আদায় করলে দম বা কুরবানি দিতে হবে।

৯. দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন কংকর নিক্ষেপ (ওয়াজিব)

১০, ১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করা এবং ১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থিত তিন জামরায় ৭টি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা। প্রথমে ছোট জামরায় তারপর মধ্যম, অতপর বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা। সর্বক্ষেত্রে দুর্বল ও নারীদের জন্য রাতের বেলায় কংকর নিক্ষেপ করা উত্তম।

> মিনায় রাত যাপন

মিনায় অবস্থানরত দিনগুলোতে ১০-১২ জিলহজ পর্যন্ত মিনাতেই রাত যাপন করা। যারা মিনা ত্যাগ করবে তারা অবশ্যেই ১২ তারিখ সুর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করতে হবে।

> মিনা ত্যাগ

১৩ জিলহজ মিনায় না থাকতে চাইলে ১২ জিলহজ সন্ধ্যার আগে মিনা ত্যাগ করা। সুর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করা উত্তম। ১৩ জিলহজ মিনায় অবস্থান করলে প্রত্যেক জামারাতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ শেষ করে মিনা থেকে ফিরে আসা সুন্নাত।

১০. বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব)

সমগ্র বিশ্ব থেকে আগত সব হজ যাত্রীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। তবে হজ শেষে যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফ পরিণত হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তামাত্তু হজ যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়