ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শেখ রাসেল, নিষ্পাপ কোমলমতি শিশু

মোহাম্মদ আবু তৈয়ব

প্রকাশিত: ১৪:১৬, ১৮ অক্টোবর ২০২১  

শেখ রাসেল

শেখ রাসেল

ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছিন্নমুকুল কবিতার পঙ্ক্তি ‘সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল/সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।/ছোট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,/সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।’ শত বছর আগের এই কবিতাটি যেন শেখ রাসেলের জন্যই লেখা। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে শেখ রাসেলের জন্ম। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। জন্মের সময় বাবা কাছে না থাকলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-পুত্রের চিরপ্রস্থান ঘটেছিল একসঙ্গেই। পৃথিবীর সুন্দরতম নিয়ামত সন্তান। মহান আল্লাহ সন্তানকে জীবনের শোভা বলে আখ্যা দিয়েছেন। শেখ রাসেল ছিল জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের শোভা। মা-বাবা, ভাইবোন সবার কলিজার ধন, নয়নের মণি। যাকে নিয়ে পরিবারের সবাই হাজারো স্বপ্ন বুনেছিলেন। সবার আদরের সেই রাসেলকেই মানুষবেশী একদল হায়েনার হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় ছোট শিশু রাসেল। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ড বিরল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে নিরাপদে সরে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে আটক করা হয়। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।

বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’। রাসেল অর্থ দীর্ঘকায় এবং নেতৃত্বদানকারী। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ছোট্ট রাসেল জন্মেছিল নেতার অবয়ব নিয়ে এবং নেতৃত্বের গুণ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা : অ্যা ডটারস টেল’-এ তিনি বলেন, ‘রাসেল হওয়ার পরে আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি হই। যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলত। ওইটুকু একটা মানুষ, খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি।’ এই ব্যক্তিত্ব ও স্ট্রং পার্সোনালিটির মধ্যে নেতা হওয়ার অযুত স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মাত্র ১০ বছর ১০ মাসে বাঙালির এই স্বপ্নবৃক্ষ উপড়ে ফেলা হয়।

আমি মনে করি, ১০ বছর ১০ মাস সময়টার মধ্যে এক ধরনের অলৌকিকতা আছে। এই বয়সের শিশু নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। সব ধর্মে ও আইনে শিশুদের নিষ্পাপ ভাবা হয়। এমন একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করা ঘাতকদের কাপুরুষতা ও ভীরুতার নিকৃষ্টতম নজির। এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের তুলনা চলে কারবালা ট্র্যাজেডির সঙ্গে। মহররমের ১০ তারিখ ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় ৪ হাজার যোদ্ধা হোসাইন (রা.)-এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। এ যুদ্ধে একমাত্র ছেলে জয়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও নারীসহ সবাই একে একে শাহাদতবরণ করেন। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের ছয় মাসের শিশুসন্তান আলি আসগর ইয়াজিদ বাহিনীর তীরের আঘাতে শাহাদতবরণ করেন। আশ্চর্য হলো, শেখ রাসেলকেও এমন নির্মম ভাগ্যবরণ করতে হয়। মা, বাবা, দুই ভাই, দুই ভাবী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সব শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা তখন কষ্টে ব্যথা-বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে তার মনের কী অবস্থা হয়েছিলকী কষ্টই না সে পেয়েছিল, তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।

এভাবে নারী ও শিশুহত্যা পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজের আইনেই বৈধ নয়। এটি সুস্পষ্ট মানবাধিকার লংঘন। ইসলামের দৃষ্টিতেও তা মারাত্মক অপরাধ। প্রিয় নবী (সা.) এক শিশু হত্যাকারীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ইহুদি কোনো এক আনসারি মেয়ে (শিশু)-কে তার গহনার জন্য হত্যা করল। এরপর তাকে একটি কূপে ফেলে দিল এবং তার মাথা পাথর দ্বারা পিষে দিল। এরপর তাকে পাকড়াও করা হলো এবং রাসুল (সা.)-এর কাছে আনা হলো। তিনি নির্দেশ দিলেন, তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করার জন্য। তখন তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হলো। অবশেষে সে মারা গেল।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪২৫৫) এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুহত্যা কতটা জঘন্য অপরাধ।

নারী ও শিশুদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম এতটাই গুরুত্ব দেয় যে, যুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং যে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, তোমরা তার ওপর আক্রমণ করো, যেরূপ সে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। আর আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৪) ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘কোনো এক মহিলাকে কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। তখন রাসুল (সা.) নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৪৪০)

শেখ রাসেল রাজনীতির কিছুই বুঝত না। সে ছিল নিষ্পাপ কোমলমতি শিশু। তাকে এভাবে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নির্মমভাবে হত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ। পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মমভাবে নিরপরাধ শিশুদের হত্যা করেছিল, ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মানব ফেরাউন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদের ফেরাউনের দল থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদের কঠিন শাস্তি দিত। তোমাদের পুত্রসন্তানদের জবাই করত এবং তোমাদের নারীদের বাঁচিয়ে রাখত। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ছিল মহাপরীক্ষা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৯)

আমার মনে হয়, ১৯৭৫ সালে নিরপরাধ শেখ রাসেলকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তারা ফেরাউনের উত্তরসূরি। বরং তার চেয়েও নির্মম। কারণ ফেরাউন তো নারীদের বাঁচিয়ে রাখত, আর তারা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব নিরপরাধ নারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মহান আল্লাহ তাদের বিচার করুন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়