ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

যে উপায়ে মানত করতে হয়

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ২০ জানুয়ারি ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মানত সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। মানত করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার। কোনো মানত সহিহ হওয়ার জন্য এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে তা মানত হিসেবে বিবেচ্য হওয়ার জন্য কয়েকটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছে।

নিচে সংক্ষিপ্তভাবে আমরা সেই বিষয়গুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে-

এক. মানতকৃত বিষয়টি মৌলিক ইবাদত হতে হবে, অন্য কোনো ইবাদতের ভূমিকা বা সহায়ক নয়। যেমন—নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি মৌলিক ইবাদত; কিন্তু অযু করা, রোজার নিয়ত করা, হজ আদায়ের উদ্দেশ্যে সফর করা, যাকাত প্রদানের মানসে খাদ্য-বস্ত্র ক্রয় করা ইত্যাদি মৌলিক ইবাদত নয়; বরং পূর্বোক্ত ইবাদতসমূহের ভূমিকা ও সহায়ক।

দুই. মানত সহিহ হওয়ার জন্য মানতকৃত বিষয়ের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু পারিভাষিক ওয়াজিব বা ফরজে আইন হতে হবে। মানতকৃত বিষয়ের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু যদি ফরজে আইন বা পারিভাষিক ওয়াজিব না হয়ে থাকে, তাহলে মানত সহিহ হবে না। যেমন কেউ যদি মাদরাসায় পড়ার বা পড়ানোর মানত করে, কিংবা মসজিদে প্রবেশ, রাস্তা-ব্রিজ নির্মাণ কিংবা কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার মানত করে ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার মানত শরিয়তের দৃষ্টিতে মানত হিসেবে ধর্তব্য হবে না। (মানত হিসেবে ধর্তব্য না হলেই যে তা আর করা যাবে না—এমন তো নয়।)

মানতকৃত বিষয়টির শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু যদি পারিভাষিক ওয়াজিব বা ফরজে আইন হয়ে থাকে, তখনই মানত সহিহ হবে। যেমন- কেউ শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার মানত করলো, তার এই মানত সহিহ হয়ে যাবে। কারণ শাওয়ালের ছয় রোজার শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু ফরজে আইন রয়েছে, আর তা হলো রমজানের রোজা। রোজা, নামাজ, সদকা, ইতিকাফ, ওয়াকফ, তাওয়াফ, দাসমুক্তি, কোরআন তেলাওয়াত, দুরুদ পাঠ, তাসবিহ আদায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানত সহিহ হবে।

তিন. মানতের ক্ষেত্রে মনের নিয়তের বিবেচনা করা হয় না; বরং মুখে উচ্চারিত শব্দের বিবেচনা করা হয়। ভুলেও যদি কোনো কিছুর মানত মুখে উচ্চারণ করে বসে, তাহলেও তা পূর্ণ করা অপরিহার্য হয়ে যায়। বিয়ে, তালাক, কসম এবং মানতের ক্ষেত্রে ভুল বা দুষ্টুমির কোনো বিবেচনা নেই। ভুলে বা দুষ্টুমি করে কোনো কিছু বললেও তা অবধারিত হয়ে যায়।

চার. মানত শর্তযুক্ত হতে পারে, আবার শর্তহীনও হতে পারে। শর্তহীন মানত, যেমন আমি এ বছর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবো। আর শর্তযুক্ত মানত, যেমন আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়, তাহলে আমি এতো টাকা সদকা করবো।

পাঁচ. মানতের ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি পূর্ণ করা জরুরি। অতিরিক্ত যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য তার সাথে যুক্ত করা হয়ে থাকে, তা পূর্ণ করা জরুরি নয়। যেমন কেউ মানত করলো, আমি পাঁচশ টাকার এই নোটটা অমুক গরিব ব্যক্তিকে অমুক স্থানে বসে সদকা করবো; তাহলে তার জন্য উপরিউক্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো পূর্ণ করা অপরিহার্য হবে না।

তেমনি কেউ যদি মানত করে যে, আমি ধনীকে সদকা করবো, তাহলে গরিবকে সদকা করাই অপরিহার্য হবে। তবে সে যদি “ইবনুস সাবিল” উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। তখন “ইবনুস সাবিল”কে সদকা করা অপরিহার্য হবে। কেননা ধনী ব্যক্তি সদকার খাত নয়, গরিব এবং ইবনুস সাবিল সদকার খাত।

ইবনুস সাবিল হলো এমন ব্যক্তি, দেশে যার অনেক অর্থসম্পদ রয়েছে; কিন্তু সে এখন সফরে রয়েছে। এখন তার হাতে রাহাখরচ নেই। সে একজন অসহায় মানুষে পরিণত হয়েছে।

ছয়. মানত সহিহ হওয়ার জন্য মানতকৃত বিষয়টি মৌলিকভাবে হারাম হতে পারবে না। ইমাম তাহাবি রহ. বলেন, কেউ যদি মানত করে যে, আমি অমুককে হত্যা করে ফেলবো, তাহলে তা মানত হবে না, বরং কসম হিসেবে ধর্তব্য হবে। তার ওপর সেই কসম ভঙ্গ করা ও তার কাফফারা আদায় করা অপরিহার্য হবে।

সাত. মানত করার আগে মানতকৃত বিষয়টি তার ওপর অপরিহার্য থাকতে পারবে না। যদি কেউ এমন কিছুর মানত করে, যা পূর্ব থেকেই তার ওপর অপরিহার্য, তাহলে তাকে তার মানতও পূরণ করতে হবে। এমনকি যা পূর্ব থেকে অপরিহার্য, তাও স্বতন্ত্রভাবে আদায় করতে হবে। যেমন- কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব, এখন সে মানত করলো যে, আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়, তাহলে আমি একটি গরু কোরবানি করবো। তো যখন তার ছেলে সুস্থ হবে, তখন তাকে স্বাভাবিক কোরবানিও করতে হবে এবং মানতের কারণে আরেকটি স্বতন্ত্র ওয়াজিব কোরবানিও আদায় করতে হবে।

আট. অন্যের মালিকানাধীন বস্তুর ক্ষেত্রে মানত করলে মানত সহিহ হয় না। তেমনিভাবে নিজের মালিকানার অতিরিক্ত বস্তুর মানত করলেও তা সহিহ হয় না। যেমন কেউ যদি মানত করে যে, আমি একহাজার টাকা সদকা করবো আর তার মালিকানায় থাকে পাঁচশ টাকা। তাহলে তার ওপর পাঁচশ টাকা সদকা করা অপরিহার্য হবে; একহাজার টাকা নয়।

নয়. অসাধ্য-অসম্ভব বিষয়ের মানত শরিয়তের দৃষ্টিতে মানত হিসেবে ধর্তব্য হয় না। অসাধ্য ও অসম্ভব হওয়ার দুই অর্থ— এক. প্রাকৃতিকভাবে বিষয়টি অসম্ভব। যেমন গতকালের রোজা বা ইতিকাফের মানত। দুই. শরিয়তের দৃষ্টিতে অসম্ভব। যেমন ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ের রোজা রাখার মানত।

দশ. মানত হওয়ার জন্য মুখে উচ্চারণ করা শর্ত। অন্তরের নিয়ত ও সংকল্পের দ্বারা মানত হয় না। মুখ দিয়ে যা উচ্চারণ করা হবে, শুধু তা-ই ধর্তব্য হবে। যদি অন্তরে এক জিনিস থাকে আর মুখে ভুলবশত অন্য কিছু উচ্চারণ করে বসে, তাহলে উচ্চারণকৃত বিষয়ই তার ওপর অপরিহার্য হবে।

এগারো. নাবালিগের মানত ধর্তব্য হয় না। সুতরাং নাবালিগ অবস্থায় কোনো মানত করলে বালিগ হওয়ার পর তা পূরণ করা অপরিহার্য হবে না।

বারো. আল্লাহর নামে মানত করা জায়েয আর গাইরুল্লাহর নামে মানত করা হারাম ও শিরক।

তেরো. ধনী লোকদের জন্য মানতের বস্তু খাওয়া এবং গ্রহণ করা জায়েয নেই; যেমনিভাবে তাদের জন্য যাকাত ও সদকাতুল ফিতর জায়েয নেই। যারা সাইয়িদ, তাদের জন্যও মানতের বস্তু জায়েয নেই।

চৌদ্দ. শর্তযুক্ত মানতের ক্ষেত্রে শর্ত পাওয়া যাওয়ার পরই কেবল মানত পূরণ করা অপরিহার্য হয়; তার পূর্বে নয়। এমনকি কেউ যদি শর্ত পাওয়া যাওয়ার আগে মানত আদায় করে দেয়, তাহলে তা মানত হিসেবে আদায় হয় না। যেমন উদাহরণস্বরূপ কেউ মানত করলো, যদি অমুক অপ্সরীকে আমি বিয়ে করতে পারি, তাহলে আমি তিনটি রোজা রাখবো। এখন সে যদি মেয়েটিকে বিয়ে করার আগেই সেই তিনটি রোজা রেখে ফেলে, তাহলে এর দ্বারা তার মানত পূরণ হবে না; বরং তা সাধারণ নফল রোজা হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে নসিবে থাকলে বিয়ের পর পুনরায় তাকে তিনটি মানতের ওয়াজিব রোজা রাখতে হবে।

পনেরো. মানত করার পর তা পূরণ করার ক্ষেত্রে অযথা বিলম্ব করা অনুচিত। কেননা মানত পূরণ করার পূর্বে কারো মৃত্যু এসে গেলে এজন্য সে গুনাহগার হবে।

ষোলো. কেউ যদি কোরআন তেলাওয়াত করার মানত করে, তাহলে তার মানত সহিহ হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি অন্যকে দিয়ে কোরআন পড়ানোর বা খতম করানোর মানত করে, তাহলে সেই মানত সহিহ হবে না। একই কথা রোজা, নামাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। নিজে করার মানত করলে তা শুদ্ধ হবে। অন্যকে দিয়ে করানোর মানত করলে শুদ্ধ হবে না।

সতেরো. কেউ যদি অত্যাধিক পরিমাণ নফল নামাজ বা অন্য কোনো ইবাদত করার মানত করে, তাহলে তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব। এর জন্য কাফফারা বা অন্য কোনো বিকল্প নেই।

আঠারো. মানত করার পর মানতকৃত বিষয় পূরণ করা জরুরি। রোজা রাখার মানত করে রোজার ফিদয়া দেয়া যথেষ্ট নয়। লাগাতার নির্দিষ্ট মেয়াদী রোজা রাখার মানত করলে সেই নির্দিষ্ট মেয়াদে রোজা লাগাতার রাখা জরুরি। আর মানতের সময় লাগাতার রাখার কথা উল্লেখ না করে থাকলে, তা বিরতির সাথেও রাখা যায়; লাগাতার রাখা জরুরি নয়।

উনিশ. মসজিদ নির্মাণের মানত করলে মানত সহিহ হবে না। কেননা মসজিদ নির্মাণ যদিও ওয়াজিব; কিন্তু তা মৌলিক ইবাদত নয়। তেমনি কেউ যদি তাবলিগে যাওয়ার মানত করে, তাহলে সেই মানতও সহিহ হয় না এবং তার জন্য মানতের কারণে তাবলিগে যাওয়া অপরিহার্য হয় না। এর আলোচনা পূর্বের পোস্টে বিগত হয়েছে।

বিশ. পশু জবাইয়ের মানত করলে পশুও জবাই করা যায় এবং তার মূল্যও সদকা করা যায়। তবে কোরবানির মানত করলে মানতকৃত পশুকেই কোরবানি করতে হয়।

একুশ. কসম এবং মানতের শব্দের ক্ষেত্রে ‘উরফ’ তথা সমাজে প্রচলিত শব্দের বিবেচনা করা হয়। সুতরাং উরফে যে সকল শব্দকে মানতের শব্দ মনে করা হয়, সেগুলোর দ্বারা মানত হবে।

বাইশ. আল্লামা যফর আহমদ উসমানি রহ. বলেন, কেউ যদি কোনো পশু সদকা করার মানত করে, তাহলে তাকে এমন পশু সদকা করতে হবে, যা কোরবানির ক্ষেত্রে বিবেচ্য। অর্থাৎ ছাগল হলে একবছর বয়সী ছাগল আর গরু হলে দু’বছর বয়সী গরু।

তেইশ. হজরত বলেন, কেউ যদি মসজিদে টাকা দেয়ার মানত করে আর এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হয় মসজিদকে ‘হিবার মাধ্যমে মালিক বানিয়ে দেয়া, তাহলে তার মানত সহিহ হবে না। অবশ্য সতর্কতার দাবি হবে, সেই পরিমাণ টাকা মসজিদে দান করা।

চব্বিশ. ইসালে সাওয়াবের মানত সহিহ নয়। কেউ যদি মানত করে যে, আমার অমুক কাজটি হয়ে গেলে আমি এই পরিমাণ দুস্থ ব্যক্তিকে খাইয়ে অথবা এই পরিমাণ অর্থ সদকা করে অমুক মৃত ব্যক্তির নামে ইসালে সাওয়াব করবো, তাহলে তার জন্য ইসালে সাওয়াব করা অপরিহার্য হবে না। কেননা ইসালে সাওয়াবের শ্রেণিভুক্ত কোনো কিছু ফরজে আইন বা পারিভাষিক ওয়াজিব নয়।

পঁচিশ. মাজারে পীরদের ব্যাপারে শিরকি আকিদা নিয়ে তাদের নামে যে সকল পশু মানত করা হয়, তা খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যদিও তা আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হয়ে থাকে।

ছাব্বিশ. কেউ যদি মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে সদকা বা অন্য কিছুর মানত করে, তাহলে এর দ্বারা যদিও সে গুনাহগার হবে, কিন্তু তার জন্য কৃত মানত পূরণ করা ওয়াজিব হবে। আর গরিব ব্যক্তিদের জন্য সেই মানতের দান-সদকা গ্রহণ করাও জায়িয হবে।

সাতাশ. মানতকৃত পশু কোরবানি করার আগে যদি মারা যায়, তাহলে এর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। মানতকৃত পশু কোরবানি করার আগে যদি সে বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে সেই বাচ্চাকেও কোরবানি করতে হবে।

আটাশ. সবশেষে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করছি। গাইরুল্লাহর নামে কসম করা জায়েয নেই। তবে কোথাও যদি কসম উদ্দেশ্য না হয়ে থাকে, বরং বাক্যের সৌন্দর্য বর্ধন উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে গাইরুল্লাহর নামেও কসম করা জায়েয।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়