ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ২ ১৪৩১

মাথা উঁচু করে আছে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বীরত্বগাঁথা ভাস্কর্য ‘আমরাও প্রস্তুত’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০  

ভাস্কর্য ‘আমরাও প্রস্তুত’

ভাস্কর্য ‘আমরাও প্রস্তুত’

চারপাশে ফসলের মাঠ। মাঝখানে পাকা প্রাচীর ঘেরা ছোট্ট সবুজ মাঠ। এর দক্ষিণ পশ্চিম কর্ণারে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম নির্যাতনে নিহত ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর চার শহিদের কবর। আর পাশেই বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নারী পুরুষের আদলে নির্মাণ করা ভাস্কর্য ‘আমরাও প্রস্তুত’।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী শত্রু বাহিনীর মোকাবিলা করতে তীর ধনুক নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতির জানান দিচ্ছেন একজন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর পুরুষ। আর যুদ্ধের সেই প্রস্তুতির অনুপ্রেরণা জোগাতে পাশেই কাঁধে সন্তান, এক হাতে খুন্তি ও অন্য হাতে তুন (তীর রাখার পাত্র) এগিয়ে দিয়ে সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার কৃষক-জনতা, কামার কুমার, তাঁতি-জেলের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী। ‘আমরাও প্রস্তুত’ ভাস্কর্যটি যেন সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। 

‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ৭ই মার্চের ভাষণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের প্রস্তুতির সেই চিত্রই ফুটে তোলা হয়েছে ভাস্কর্যটিতে। সরকারি ১৪ শতক জায়গায় ২১ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ভাস্কর্যটি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী ইউনিয়নের নন্দইল মিশন গ্রামের পাশে নির্জন মাঠে স্থাপন করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করা হয়েছে ২০১০ সালে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আমিরুল মোমেনিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. একেএম আরিফুল ইসলাম। তাদের সহযোগিতা করেন ওই বিভাগের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী। আর সেই থেকে ভাস্কর্যটি স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতীক হয়ে আছে। 

ভাস্কর্যের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে নন্দইল গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর চারজন শহিদের কবর আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে ১৯৭১ সালে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা হলেন নন্দইল গ্রামের যোহন সরেন ও তার ভাই ফিলিপ সরেন এবং খোকা হেমব্রম ও তার ভাই মন্টু হেমব্রম।

ওই সময় পরিবার ভারতে থাকলেও তারা দেশ ছেড়ে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। শত্রুদের গতিবিধির তথ্য সরবরাহসহ তারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে তাদের গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের এক সকালে বাড়ির পাশের জলাশয়ে পাট ধৌতের কাজ করার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাত সদস্যের একটি দল পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ পাঁড়ুইল গ্রামে তাদের ধরে নিয়ে যায়। সেখানে আবুল হোসেন নামে একজনের বাড়িতে নিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। পরে ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে সেখানে ফেলে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর তাদের মাটি চাপা দেয়। দেশ স্বাধীনের পর তাদের স্বজনরা ওই গর্ত থেকে হাড় ও অস্থি নিয়ে এসে নন্দইল গ্রামের পাশে তাদের কবর দেয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধে চার শহিদের এই আত্মদানের জন্য কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দেশের জন্য তাদের বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস তুলে ধরতেই কবরের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘আমরাও প্রস্তুত’ নামের ভাস্কর্যটি। 

ভাস্কর্যটির উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,গবেষক এবং জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আমিনুল হক বাবুল বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর আত্মদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্মরণীয় রাখার লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী পল্লীর ওই নির্জন এলাকায় ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে।

এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ লাখ টাকারও বেশি। যার প্রধান অর্থ জোগানদাতা ছিলেন জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান। এ ছাড়া স্থানীয় এমপি, পৌর মেয়র, সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধারা এবং এলাকার প্রগতিশীল চেতনার ব্যবসায়ীমহল সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অর্থ ও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। 

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়