ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ৪ ১৪৩০

বিনয় মজুমদার : একজন কালের এবং কালান্তরের কবি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৫৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২  

বিনয় মজুমদার : একজন কালের এবং কালান্তরের কবি

বিনয় মজুমদার : একজন কালের এবং কালান্তরের কবি

‘আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো। তোমার গায়ের রং এখনো আগের মতো, তবে তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো। তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি। আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন তোমার মাথার চুল সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা, ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে যুবতী ও যুবক ছিলাম তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব’

কবিতার লাইনগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায় অন্যরকম একটি বোধ, এখানে স্বতন্ত্রভাবে সাঁতার কাটছে। এই সাঁতার কাটার কাজটি খুব সহজে করেছেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, গণিতবেত্তা ও কবি। বলছি বিনয় মজুমদারের কথা। তিনি ছিলেন এক বর্ণের নানা সত্তার মানুষ। যার কবিতায় কথা বলেছে মানুষ, পৃথিবী, সময়, আর প্রেমকে নিয়ে। এই চারটি উপাদানের ভিতর দিয়ে কবিতায় খুঁজেছেন নতুন সত্তা। তিনি আমাদের শুভ প্রবৃত্তিকে ‘আমি’-র কারাগার ভেঙে আমাদের মধ্যে তিনি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন কবিতার মাধ্যমে।

যদিও বিনয়ের কবিতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেকে মনে করেন তার কবিতা মানে অশ্লীলতায় ভরপুর আবার অনেকে ভাবেন বাস্তবতার দর্শন। তবে মননশীলতার স্থান থেকে বিনয় নক্ষত্রের মতো। তবে তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে আধুনিক সমাজ জীবন, হতাশা ও যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেছেন- ‘আকাশে হৃদয় মেলে মন ঝাপটিয়ে আমি তালে-তালে মন ঝাপটিয়ে কবিতার মতো উড়ি, সকল পাহাড় ঘিরে, বাড়ি ঘিরে, চূড়া ঘিরে ঘিরে। আকাশে চলতে হলে মানুষের মতো নয় কবিতার মতো হতে হয়, বাজপাখিদের মতো হতে হয় একেবারে আকাশের মতো জায়গায় চলাফেরা করবার নিমিত্ত--সত্যই যদি চলবার দরকার হয়।’

বিনয় অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনে থাকলেও তার কবিতায় প্রেমিকসত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় নিয়ে গিয়েছেন। তিনি নারীকে ফাঁদে ফেলে বা তার চলার পথ রুদ্ধ করে প্রেমময় উপখানের কথা বলেননি। প্রেমিক বিনয় ছিলেন নির্নিমেষ জ্যোৎস্নার সন্ধানে ব্যস্ত থাকা একজন মানুষ। প্রেম ও অ-প্রেমের মত তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণায় কবিমানস নির্বিবাদে ঘুরপাক খেয়েছে কবিতার বেলাভূমি। কাঙ্ক্ষিত নারী হৃদয়ের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তবে মনোজাগতিক জটিল ঘূর্ণন তার কবিতায় যে আলো-আঁধারের চিত্রকল্পে, নৈঃশব্দ্য পরিক্রমণ করেছে তা অনবদ্য এক সৃষ্টি। তিনি বলেন- ‘আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত কিছু ছন্দে, ভীরু মিলে আলোড়িত কাব্যের কণিকা এখন বিক্ষিপ্ত নানা বায়ুপথে, ঝড়ের সম্মুখে। আমাকে ডাকে না কেউ নিরলস প্রেমের বিস্তারে।’

অথবা

‘আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে। অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল’।

কবিতার রস আস্বাদন করতে হলে দর্শন দিয়ে নয় খুঁজতে হয় সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে। আবার সৌন্দর্যের মধ্যে দর্শন খোঁজা বোকামিই বলা যায়। বিনয়ের কবিতায় সৌন্দর্যের একটি অন্য জগত যেমন বিদ্যমান তেমন দর্শনেরও। তার কবিতায় সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান শুধু ফুলকে ঘিরেই নয়, কাঁটা নিয়েও। এই দার্শনিক তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে ‘আত্মপরিচ’-এ লিখেছেন, ‘এইসব দার্শনিক বিষয় ভাবতে ভাবতে আমার সময় চলে যেত মাসের পর মাস। এখনো আমি ভেবেই চলেছি। এই দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষ না হলেও চলে, হয়তো তার আভাস মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাসই হোক আর যা-ই হোক উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন।’

তবু এ কথা স্বীকার্য যে দর্শনের জন্য কবিতা পাঠ নয়, কবিতার জন্যই কবিতা পাঠ। বিনয় তার ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ কবিতায় বলেছেন- ‘একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেলো-এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে বেদনায় গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।’

বিরহের জীবনকে বিনয় মজুমদার গাণিতিক সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য বারবারই বাস্তব আর বিরহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্যদর্শন বোঝার চেষ্টা করেছেন, গণিতের সূত্রে জীবনের মর্মার্থ অন্বেষণে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে কবিতায় ব্যক্তিক অভিনবত্ব, প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতার গভীর পাঠে এক ধরনের মনোবৈকল্য ধরা পড়ে। গ্রন্থটির শেষের কবিতাগুলোতে তাকে কামোন্মাদ হতে দেখি। নারীবাদী চিন্তায় তার জাগতিক সংকল্প প্রকাশিত হয় বিচ্ছেদের প্রজ্ঞারূপে। জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় মজুমদার না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্থাপন করেন।

‘রক্তের ভিতরে জ্যোৎস্না; তবু বুঝি, আজ পরিশেষে মাংসভোজনের উষ্ণ প্রয়োজন; তা না-হলে নেই মদিরার পূর্ণ তৃপ্তি; তোমার দেহের কথা ভাবি - নির্বিকার কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার, সুখ এমন আশ্চর্যভাবে মিশে আছে;

অথবা

‘কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে-ক্রমাগত ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে, আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে। আড়ালে যেও না যেন’

বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে ফার্নান্দো পাসোয়ার মতো বিনয়ের কবিতাও তার আত্মজীবনীরই অংশ। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের ৭৩ বছরের জীবন তা কবিতার ভাঁজে ভাঁজে জীবাশ্ম হয়ে আছে।

তার কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, ‘বিনয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি গত ২২ বছর ধরে অফুরান পাঠ্য আমার। সম্পূর্ণভাবে বিদ্বেষমুক্ত এঁর কাব্য। এই কবিতা বদাপি কোনো তিক্ততা প্রকাশ করে না। প্রতিহিংসার ছায়ামাত্র নেই, আজকের নতুন বাংলা কবিতাচর্চায় যুগধর্মোচিত ও ব্যক্তিহিংসার অবিরল যে গরলপাত ঘটে চলেছে সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে বিনয়ের কবিতার দিকে তাকালে দেখা যায়, এমন কী ব্যঙ্গবিদ্রূপের অতি প্রচলিত ছুরিফাটিও এ কবিতা হাতে তুলে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এ কবিতার পিছনের মন এক বিজ্ঞানীর মতো দূরগামী, গণিতজ্ঞের ন্যায় যুক্তিপথ মান্যকারী, আবার বালকসুলভ বিস্মিত অবুঝ এক জিজ্ঞাসুও এই মন। এই কাব্যের প্রণেতাকে নব্য সাহিত্য আন্দোলনকর্তা বলেও দাবি করা যাবে না।’

ওপার বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র তার এক লেখায় বিনয়ের সমালোচকদের জন্য লিখেছেন, ‘কেচোর মায়ের পুত্রশোক মাত্র দু’দিনের। গরুর মায়ের আরেকটু বেশি। এই কমবেশি হওয়ার কারণ শুধুমাত্র ঘিলুর তারতম্য।’ এসব কথা এজন্যই বলা যে, বাজার অর্থনীতির পণ্য দস্যুতা। এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর ধাক্কা মননশীলতার ওপরও যেন আছড়ে পড়েছে। যার পরিণতির নাম ‘ডিজ্যুস সংস্কৃতি’। এই সংস্কৃতি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের বড় ধরনের সর্বনাশ করেছে। বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে যারা কবিতা সম্বন্ধে আলোচনার ধৃষ্টতা দেখায়। একবারে যে কোনো কাউকে তারা অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু এই প্রবণতাকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছে যে, বিনয় মজুমদারের মতো কবির কবিতাকে তারা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট করে। তার কবিতার সমালোচনা করার স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু সমালোচনা যেখানে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয় সেখানে আর বলার কী থাকে!’

প্রেমে-ব্যর্থতা বিনয়কে করে তোলে ছন্নছাড়া। তিনি একসময় মানসিক ব্যাধির শিকার হন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কেউ আমাকে সুখ দেয়নি, কেউ আমাকে ভালোও বাসেনি।’ এই মানুষটি ১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বার্মার মিকটিলা জেলার তেডো শহরের নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র - ১. ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ - শ্রীতপন কুমার চট্টোপাধ্যায়। ২. ‘বিনয়ের 'ফিরে এসো চাকা’য় প্রেম’ - অধ্যাপক বীরেন মুখার্জী। ৩. ইন্টারনেট।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়