ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ৫ ১৪৩০

বিজয়ের এই দিনে : ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২২  

বিজয়ের এই দিনে : ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি

বিজয়ের এই দিনে : ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি

বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের সংসদে এ ঘোষণা দেন। পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে চিঠি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা দেন, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, বিরাট বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের মন পড়ে রয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে।’ পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

স্বীকৃতির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে ভারতের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডকেও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শাহীন সামাদ, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলা মোমেন, শারমিন মুরশিদ প্রমুখ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেন।

আবার সোভিয়েত ভেটো : ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং দুই দেশের সেনা অপসারণের দাবি জানিয়ে ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব পেশ করে, এদিন আবার সোভিয়েত ভেটোয় তা বাতিল হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ নিয়ে দুবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ১১টি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পেশ করে। প্রস্তাবটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোট দেয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব তোলে। রাতে নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়।

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ এবং ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়। জর্জ বুশ পাকিস্তানে আক্রমণের জন্য ভারতকে দায়ী করেন। সমর সেন বাংলাদেশের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিন্দা না করায় দুঃখ প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আনা দুটি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ সাধারণ পরিষদে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে মধ্যস্থতা করতে কথা বলার বিষয়টি ভাবছে। সেনা অপসারণের কথা না বলে শুধু যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব গ্রহণের জন্য এদিন নিরাপত্তা পরিষদের আবারও বৈঠক বসার কথা ছিল।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতকে সেখান থেকে পণ্য আমদানির জন্য মঞ্জুর করা ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ এদিন স্থগিত করে। পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র চালার্স ব্রে বলেন, ভারতকে সামরিক তৎপরতায় সাহায্য করতে পারে এমন আর্থিক সাহায্য যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রেত নয়। যুক্তরাজ্যের সংসদের অধিবেশনে টোরি সদস্য ডানকান স্যান্ডস সোভিয়েত ভেটোর সমালোচনা করেন। তবে জন স্টোনহাউস মার্কিন প্রস্তাবে বিরত থাকায় সরকারের প্রশংসা করেন। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক মুখপত্র ল্যুমানিতে প্রকাশিত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য ইয়াহিয়া খানের তীব্র নিন্দা করা হয়। বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সমালোচনা করে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং যুদ্ধসংক্রান্ত রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য আলোচনা শুরু করার দাবি জানানো হয়।

পতনের মুখে যশোর : মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত যৌথ বাহিনী রাতে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। তারা জানায়, আত্মসমর্পণ করলে তারা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার পাবে। এ অবরোধে যশোর সেনানিবাস ঢাকা ও খুলনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেনানিবাস এলাকা ছাড়া যশোর শহরসহ আশপাশের বেশিরভাগ এলাকা এদিন পাকিস্তানি সেনামুক্ত হয়। এর আগে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ সময় শহরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসে সমবেত হয়। এর পর রাতের অন্ধকারে তাদের বেশিরভাগ সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায়। এদিন মুক্ত হয় চাঁদপুরের কচুয়া, নীলফামারীর ডোমার ও কুড়িগ্রামের রাজারহাট। ৬ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ডোমারকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পাকিস্তানের তৎপরতা : বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় পাকিস্তান এদিন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। স্বীকৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান এ ঘোষণা দেয়। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করছে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়