ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বাঙালির ইতিহাসে এক অন্তহীন আবেগ শেখ রাসেল

এয়াকুব আলী

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৮ অক্টোবর ২০২১  

শেখ রাসেল

শেখ রাসেল

১৯৩৫ সালে আলস্যের জয়গান বইয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল জগতের সকল দুর্ভোগের মূলে অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতার কথা বলেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকারীদের বুলেট যখন ১১ বছরের রাসেলের বুক বিদীর্ণ করে মেঝেতে আছড়ে পরে তখন অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতার নিদারুণ প্রকাশ দেখা যায়। শুধু বাঙালির ইতিহাসই নয়, মানবজাতির ইতিহাসে এ এক অন্তহীন আবেগের দিন যেখানে জন্ম দিনের আলোচনায় মৃত্যুর নৃশংসতা উপস্থিত হয়ে মনকে ক্ষতবিক্ষত করে। তাই শেখ রাসেলকে ঘিরে উচ্চারণগুলি শোক ও শূন্যতার, হাহাকার ও স্তব্ধতার। ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। ‘শেখ রাসেল: দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস’ স্লোগানে বেদনা আর ভালবাসায় আমরা শেখ রাসেলকে স্মরণ করছি।

১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন চিত্র বাংলায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে স্বজন হারানোর হাহাকার। দুঃসহ যন্ত্রণার চিহ্ন শেখ রেহানার চোখে স্পষ্ট। যেন ‘ঝর ঝর ঝরে অবিরল অশ্রুধারা তিতিয়া বসনে।’ শিশু রাসেলের রক্তের দাগ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এখনো লেগে আছে। শুধু কী ৩২ নম্বর, বাংলার শ্যামল মাটি কী শিশুরক্তে আর্দ্র নয়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শেখ রাসেলের মৃত্যু নিয়ে লেখা ‘শিশুরক্ত’ কবিতায় বলেন, ‘তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়েসেন্তে ছিলি! তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচী হলো, শিশুরক্ত পানে গ্লানি নেই?’ শেখ রাসেলের শূন্যতা বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে বারংবার। জন্মের পরে রাসেলের নাম রাখা হয়েছিল বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে। পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনে রাসেলও ভূমিকা রাখবে সেই প্রত্যাশায়। বুলেট কত সহজেই সে আশার সমাধি ঘটিয়ে দিল।

রাসেল, মাত্র ১১টি বছর বেঁচে ছিল। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাত দেড়টায় জন্ম। শিশুকাল কেটেছে পিতাকে ইচ্ছেমত আব্বা ডাকতে না পারার আকুতি নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকাংশ সময় জেলখানায় বন্দি ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন সে আব্বা বলে ডাকত তখন মা বলতো, আমি তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা ডাকো।’ ‘পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনে’ মাথা রেখে রাসেল তৃপ্তি নিয়ে আব্বা বলে ডাকতে পারেনি। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বালি চলো। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ওতো বোঝেনা আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।”

এ বই থেকে জানা যায়, ছোট্ট রাসেল জেল গেটে আসলে বঙ্গবন্ধুকে দেখার আগ পর্যন্ত চুপচাপ থাকতো। বঙ্গবন্ধুকে দেখা মাত্রই আব্বা আব্বা বলে ডাকতে শুরু করে দিত। বিদায় নেবার সময় বঙ্গবন্ধুকে পালিয়ে বিদায় নিতে হতো। বিদায়ের পরে একদিকে বঙ্গবন্ধুর কোমল হৃদয় ব্যাথাতুর হয়ে উঠতো অন্যদিকে রাসেল পিতাকে দেখতে না পেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকতো। পিতা-পুত্রের এ বিচ্ছেদ বড়ই করুণ। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে (পৃ. ২০৯) সন্তানের সঙ্গে পিতার বিচ্ছেদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

শেখ রাসেলের বেড়ে ওঠার সময় বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন ও বিনির্মাণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। শেখ রাসেলের প্রথম সাত বছর কেটেছিল যুদ্ধাবস্থা দেখে। স্বাধীনতার পরবর্তী চার বছর পিতাকে হারানোর ভয়ে, বিচ্ছেদের ভয়ে আমরা শেখ রাসেলকে দেখি সার্বক্ষণিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হয়ে থাকতে। জাপানি চিত্রপরিচালক নাগিসা ওশিমার বিখ্যাত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল (১৯৭২)’। নাগিসা ওশিমা জানতে চান, ‘ও তো আপনার পিছু ছাড়ে না দেখছি? বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ও আমাকে সঙ্গ দেয়। প্রায়ই আমার সাথে থাকতে ভালোবাসে। ...এর একটা কারণ আছে। ওর বেড়ে ওঠার সময়টা আমার কেটেছে জেলে। বারবার জেলে যেতে হয়েছে। ওর যখন পনের মাস বয়স, জেল হয়ে গেল আমার। তিন বছরের জন্য। বের হওয়ার পর আবারো জেলে যাই দেড় বছরের জন্য। ও আমার সাথে সাথে থাকে কারণ ওর মধ্যে ভয় কাজ করে। এই বুঝি বাবা আবার জেলে যাবে। বাবাকে চোখের আড়াল করতে চায় না বলেই এই কাছে থাকা।’ নাগিসা ওশিমা, রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ১৯৭২, ০৫:০০ মিনিট।

শিশুকালেই শেখ রাসেলের অনুভূতিপ্রবণতার দিকটি প্রকাশ পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কবুতর পোষা হতো। বঙ্গমাতার সাথে রাসেলও কবুতরকে খাবার দিত। বিভিন্ন সময়ে কবুতরের মাংস রান্না করা হলেও শেখ রাসেলকে খাওয়ানো যেত না। শেখ হাসিনার লেখায় পাওয়া যায়, ‘ওকে ওই মাংস খাওয়াতে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিয়ে গেছি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে… ওই বয়সে ও কী করে বুঝতে পারতো যে, ওকে পালিত কবুতরের মাংস দেওয়া হয়েছে।’ রাসেলের চেতনাবোধ নিয়ে বর্ণনা আছে, একবার কালো বড় ওল্লা পিপড়া রাসেলের আঙুলে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দেয়। ব্যথা পেয়ে রাসেল পরবর্তীতে ওল্লা পিপড়া দেখলেই বলতো ‘ভুট্টো’। আমরা রাসেলের মেধার পরিচয় পাই গৃহশিক্ষিকা গীতালি দাশগুপ্তের লেখা থেকে।

তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘ওই সময় রাসেল এক/দুই-এর সাথে পরিচিত ছিল না। তাই ওকে এক/দুই শেখাচ্ছি। তার এই এক/দুই-এর একশ পর্যন্ত শিখতে মাত্র একটি দিন সময় লেগেছে।’ স্মরণের আবরণে আমার বুঁচুসোনা শেখ রাসেল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট, ১৭ অক্টোবর, ২০২০। রাসেল এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার ছবি এবং কোন সংখ্যার পর কোন সংখ্যা তা দেখে শিখে ফেলেছিল। আমরা বিদ্যাসাগরের সংখ্যা শেখার ইতিহাস জানি। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথমবার কলকাতায় যাওয়ার সময় রাস্তার ধারে পোঁতা মাইলস্টোন দেখে ইংরেজি সংখ্যা শিখেছিলেন। জন মিল্টনের প্যারাডাইস রিগেইনড-এ আছে, ‘দ্য চাইল্ডহুড শোজ দ্য ম্যান, এন্ড মর্নিং শোজ দ্য ডে।’ শেখ রাসেলের জীবনে ‘দিন’ আসেনি। ঘাতকেরা হত্যা করেছিল শৈশবেই। নরপিশাচের ‘গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে, হেনেছে নিঃসহায়ে।’ তাই শেখ রাসেলের ইতিহাস, একটি ফুলের মুকুলেই ‍উৎপাটিত হওয়ার করুণ ইতিহাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই রাসেল সম্পর্কে কথা বলেন, আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ যেন, ‘হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম, তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল-হৃদয় ডোবে শোক-সাগরে।’ শোকার্ত হৃদয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কবিগুরুর মতো জানতে ইচ্ছে হয়, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝিতে লিখেছেন, ‘অতিতকে নিয়া হাসিতে পারি কাঁদিতে পারি, কিন্তু ফিরিয়া তাকে পাইতে পারি না। হাতের মুঠোয় পাইতে চাই তো বর্ত্তমান, আশায় বুক বাঁধিতে চাই তো ভবিষ্যৎ। …একবার যে জন্মিয়াছে সে একদিন মরিবেই। কাজেই যে ঘরে মানুষ আছে মৃত্যু সে ঘরে ঘটিবেই। কিন্তু ঘরে মানুষ আছে বলিয়াই এবং সে ঘরে মৃত্যু একদিন ঘটিবে বলিয়াই’ নৃশংস হত্যাকাণ্ড অনুমোদিত নয়।

পরবর্তী এক দশকের বেশি সময় আমরা এ নৃশংসতার অনুমোদনই শুধু নয় হত্যাকারীদের সূর্যসন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে দেখেছি। হত্যাকান্ডের বিচার হলেও ষড়যন্ত্রের মূল উন্মোচিত হয়নি এখনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে নোবেল জয়ী লেখক এলি উইজেল লিখেছেন, ‘আমি শিশুহত্যাকারীদের ক্ষমা করব না; এবং আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব ক্ষমা না করার জন্য।’ শিশুহত্যাকারীসহ সকল হত্যাকারীর প্রতি ধিক্কার জানাই। দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায় আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’ হত্যাকরীদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষমার পরস্পর বিরোধ নিয়ে আমি ফিরে তাকাই শেখ রাসেলের ছবির দিকে। শেখ রাসেলের ছবিগুলো যেন ‘চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়