ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ইসলাম ঋণ পরিশোধকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মানব সমাজে আর্থিক সাহায্য আদান প্রদানের অন্যতম একটি প্রক্রিয়ার নাম ঋণ। এটি একটি অতি পরিচিত প্রক্রিয়া। প্রয়োজনে এ ঋণ আদান-প্রদান সমাজ জীবনের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। ইসলামও ঋণ দেয়া-নেয়াকে অবৈধ করেনি। কিন্তু ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘ধার নেয়া বস্তু ফেরৎ দেয়া অপরিহার্য।’

ঋণ একটি দায়বদ্ধতা; যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়। এ সম্পর্কে হজরত সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হাতের উপর ওই বস্তুর দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা সে গ্রহণ করেছে; যে পর্যন্ত তা প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া না হয়।’ (বুখারি)

ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব পর্যালোচনা

একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ঋণ কত গুরুতর বিষয়; যার ফলে শহিদের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হলেও ঋণ মাফ করা হবে না। অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল ইসলামের জন্য শাহাদাতবরণ করা। হাদিসে এসেছে-

তিনি বলেছেন, ‘যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! আমার আকাঙ্ক্ষা হয়- আমি আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হব। তারপর আবার আমাকে জীবিত করা হবে, আমি আবার শহিদ হব। আবার আমাকে জীবিত করা হবে, আমি আবার শহিদ হব। আবার আমাকে জীবিত করা হবে, তারপর আমি আবার শহিদ হব।’ (বুখারি)

ইসলামের জন্য শাহাদাত যেখানে মুমিন মুসলমানের শ্রেষ্ঠ আমল ও আকাঙ্ক্ষা। সেখানে কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ইসলামের জন্যও নিজের জীবন বিসর্জন দেয়; তবুও তাকে ঋণ থেকে ক্ষমা করা হবে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত তার ঋণ পরিশোধ করা হবে। ঋণ পরিশোধে এত গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে-

- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু  আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত সব গোনাহ মিটিয়ে দেয়, তবে ঋণ ছাড়া।’ (মুসলিম)

- হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শহিদের সব গোনাহ ক্ষমা করা হবে, তবে ঋণ ছাড়া।’ (মুসলিম)

- হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত সব গোনাহ মিটিয়ে দেয়।’ তখন জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, তবে ঋণ ছাড়া।’ তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বললেন, ‘তবে ঋণ ছাড়া।’ (তিরমিজি)

ইসলাম ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব এভাবেই তুলে ধরেছে। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যান তবে তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে আগে ঋণ পরিশোধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধের পর সম্পদ থাকতে তা উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করা যাবে। আগে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার প্রবণতা শয়তানের পক্ষ থেকে সৃষ্ট। তবে পাঁচটি ক্ষেত্র ব্যতিত। আর তাহলো-

- মেয়ে বয়প্রাপ্ত হলে তাকে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা।

- মেয়াদ এসে গেলে ঋণ পরিশোধ করা।

- কেউ মৃত্যুবরণ করলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা।

- মেহমান এলে তাকে আপ্যায়ন করা।

- গোনাহ হয়ে গেলে তাওবা করা।’ (মিনহাজ)

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাজা পড়েননি বিশ্বনবি

ঋণ মানুষের হক। ঋণ পরিশোধ করার আগে মৃত্যুবরণ করার মানে হলো মানুষের হক নিজের কাঁধে বহন করে নিয়ে যাওয়া। এ কারণেই  ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাজা পড়েননি বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-

- হজরত আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক ব্যক্তির জানাজা নিয়ে আসা হলে তিনি বললেন, ‘তোমরাই তোমাদের সঙ্গীর জানাজা পড়ে নাও; কারণ সে ঋণী।’ (তিরমিজি)

- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার কাছে যদি ওহুদ পাহাড় সমান সোনা থাকত, তবু আমার পছন্দ নয় যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থাকুক। তবে এতটুকু পরিমাণ ব্যতিত, যা আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দিই।’ (বুখারি)

ঋণ পরিশোধে সতর্কতা

ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে তার পরিমাণ লিখে রাখার নির্দেশনা এসেছে কুরআনুল কারিমে। যাতে কোনোভাবেই ঋণ পরিশোধে ত্রুটি না হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করবে, তখন লিপিবদ্ধ করে রাখবে এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে। লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া। ঋণগ্রহীতা লেখার বিষয় বলে দেবে। সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশকম না করে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮২)

ঋণ পরিশোধ না করার শাস্তি

ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে কোনোভাবে গড়িমসি করা যাবে না। এটি এক ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ। ইসলাম এরকম অপরাধ নিরসনেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রেখেছে। হাদিসে এসেছে-

- হজরত শারিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ধনী ব্যক্তির (ঋণ পরিশোধে) গড়িমসি করা তার মানহানী ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয়।’ হজরত ইবনুল মুবারক বলেন, ‘মানহানী হলো রাগা দেখানো আর শাস্তির অর্থ হচ্ছে বন্দী করা।’ (আবু দাউদ)

- হজরত মাকহুল রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই হকদারের রয়েছে হাত ও জিহ্বা।’ (দারাকুতনি)

এ হাদিসে হাত দ্বারা বুঝানো হয়েছে আটক করা ও শক্তি প্রয়োগ করা। আর জিহ্বা দ্বারা বুঝানো হয়েছে তাগাদা দেয়া এবং প্রচলিত আইনের আশ্রয় নেয়া।’ (ইলাউসসুনান) বিশেষ করে

ঋণ পরিশোধ করার পর কল্যাণ ও বরকতের জন্য দোয়া করা। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঋণদাতার জন্য দোয়া করেছিলেন। হাদিসে এসেছে-

হজরত ইসমাইল ইবনে ইবরাহিম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু রাবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবার মাধ্যমে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছ থেকে চল্লিশ হাজার দিরহাম ঋণ বা করজ নিয়েছিলেন। এরপর তাঁর কাছে মাল (সম্পদ) আসলে তিনি তা আদায় করেন। আর এ বলে দোয়া করেন-

بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِي أَهْلِكَ وَمَالِكَ

উচ্চারণ : ‘বারাকাল্লাহু লাকা ফি আহলিকা ওয়া মালিকা'

অর্থ : ‘আল্লাহ তাআলা তোমার ঘরে এবং মালে (সম্পদে) বরকত দান করুন।’

ঋণ বা কর্জের বিনিময় তো এই যে, লোক কর্জদাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং তা আদায় করবে।’ (নাসাঈ) মনে রাখতে হবে

প্রয়োজনের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং তা উত্তমরূপে পরিশোধ করেছেন। হাদিসে এর প্রমাণ মেলে-

- হজরত আবু রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘একদিন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তি থেকে একটি উট ধার (ঋণ) নেন। তারপর সাদকার উট আসলে আবু রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আদেশ দেয়া হয়, তিনি যেন সেই ব্যক্তির উট ফেরত দিয়ে দেন। হজরত আবু রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিরে এসে বললেন, ‘রুবায়ি মুখতার উট (সেই সমগুণের উট নেই বরং তার থেকে উত্তম; অর্থাৎ ছয় বছর বয়স অতিক্রম করে সপ্তম বছরে প্রবেশকারী পুরুষ উট) আছে।’ নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ঠিক আছে, তাই দিয়ে দাও; কারণ সেই ব্যক্তিই উত্তম যে উত্তমরূপে (ঋণ) পরিশোধকারী।’ (মুসলিম)

হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম। তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। তিনি বললেন, দুই রাকাআত নামাজ আদায় কর। তার কাছে আমার কিছু ঋণ প্রাপ্য ছিল। তিনি আমার ঋণ আদায় করলেন এবং পাওনার চেয়েও বেশি দিলেন।’ (বুখারি)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, ঋণ নিয়ে অবহেলা কিংবা গড়িমসি না করা। যথা সময়ে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করা। ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। আল্লাহর কাছে ঋণ পরিশোধে সাহায্য প্রার্থনা করা। ঋণ পরিশোধের পর তার জন্য বরকত ও কল্যাণের দোয়া করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ঋণসহ বান্দার সব ধরনের হক সঠিক সময়ে যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর আগে তা পরিশোধের তাওফিক দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়