ভুঁইফোঁড় সংবাদমাধ্যম খুলে মনগড়া খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে বার্গম্যান-খলিল

রাজনীতি ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৩:৩৬ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার

বার্গম্যান-খলিল

বার্গম্যান-খলিল

যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে (এইচআরডব্লিউ) ব্যবহার করে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে নেমেছেন যুদ্ধাপরাধীদের দোসর ডেভিড বার্গম্যান ও সুইডেনপ্রবাসী তাসনিম খলিল। বর্তমানে নেত্রনিউজ নামের একটি ভুঁইফোঁড় সংবাদমাধ্যম খুলে বাংলাদেশ সরকার, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে নিয়ে তারা মনগড়া খবর প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

এর আগে দোহাভিত্তিক আল-জাজিরার ‘অল প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে তাদের। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে কল্পনাপ্রসূত খবর প্রকাশ করা হয়েছে।

এক ‘গুজবগুরুর’ নাম তাসনিম খলিল

সামাজিক মাধ্যমে ‘গুজবগুরু’ নামে পরিচিত তাসনিম খলিল। নেত্রনিউজের এ সম্পাদক ২০০৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরামর্শদাতা ছিলেন। তাসনীম খলিল মনেপ্রাণে জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক বিএনপি-জামায়াত সরকারের দুর্নীতিবাজ সাবেক কর্মকর্তা শামসুল আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘গুজব সেল’-এর পেইড কর্মী হয়ে কাজ করছেন তিনি।

তাসনিম খলিলের বাবা খলিলুর রহমান কাসেমী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগবিদ্বেষী বামপন্থিদের চরমপন্থি অংশের রাজনীতিতে যুক্ত হন।

২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন তাসনিম। তখন থেকেই বাংলাদেশবিরোধী প্রচারে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের ১১ মে তাকে আটক করা হয়েছিল। পরে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে সুইডেনে আশ্রয় নেন। বিলাসী জীবনের হাতছানিতে বিভোর তাসনিম রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সুইডেনে আয়েশি জীবনযাপন করছেন।

প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরিতে উস্‌কানি দেয়াই এখন তার নিয়মিত কাজ। বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও পক্ষপাতমূলক সংবাদের কারণে ডেইলি স্টার থেকে তাকে পদচ্যুত করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচে জড়িত থাকার সময় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আক্রমণাত্মক লেখা লিখতে দেখা গেছে তাকে।

বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার দায়ে সুইডেন পুলিশের কাছে গেল বছর তার বিরুদ্ধে অভিযোগও করা হয়েছে। অভিযোগকারী নজরুল ইসলাম বলেন, তাসনিম খলিল বাংলাদেশবিরোধী যে অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, ‘সে বিষয়ে আমরা স্টকহোম পুলিশকে অবহিত করেছি।’ বিএনপিসহ বিভিন্ন মৌলবাদী দলের কার্যক্রমের সঙ্গে তার তৎপরতার মিল রয়েছে বলেও জানান তিনি।

নজরুল দাবি করেন, মহামারি করোনার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার যখন ‘চিকিৎসা খাতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে’, তখন নেত্রনিউজে প্রচার করা হয়েছে, ‘সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে না।’ নেত্রনিউজের আচরণ সরকারবিরোধী কর্মীদের মতো।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দোহাভিত্তিক আল-জাজিরার বাংলাদেশবিরোধী প্রতিবেদন সম্প্রচারের পর তাসনিম খলিলের নামটি ব্যাপক আলোচনায় আসে।

অনেকটা অযাচিতভাবেই শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাকে। ২০১৯ সালে আল-জাজিরার হেড টু হেড অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর বক্তব্যের মধ্যে তাসনিমকে এনে বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে তাকে।

যুদ্ধাপরাধের দোসর ডেভিড বার্গম্যান

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, দেশ উন্নতি করছে, ডেভিড বার্গম্যানের সেটা পছন্দ নয়। তাই তারা গুম-খুনের অভিযোগ করছে। অভিযোগ রয়েছে, ডেভিড বার্গম্যান টাকা নিয়ে এসব কাজ করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও তিনি বিপক্ষে কাজ করেছেন।

ডেভিড বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধীদের এজেন্ট এবং তারেক রহমানের বেতনভুক উপদেষ্টা বলে জানা গেছে। যিনি বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেনের জামাতা।

প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকতা করেন ডেভিড বার্গম্যান। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করাই যার মূল লক্ষ্য। বার্গম্যান মূলত নিজেকে পরিচয় দেন একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক হিসেবে। অনেক বছর তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। তখন একটা বিশেষ শ্রেণির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি জড়িতদের বিচারের বিরোধিতা করে নিজের ব্লগে লেখালিখি করে তিনি আলোচনায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যাসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িতদের বিচার শুরু হলে তা নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখিও করেন বার্গম্যান।

এ বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। বেশির ভাগ লেখায় তিনি শুধু সেসব মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেন, যারা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর এটা সবাই জানে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান সহযোগী। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা এ দেশে গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।

নিজের লেখা এক ব্লগে বার্গম্যান এটাও দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধে আসলে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি। তার দাবি, এ সংখ্যা ছিল মাত্র তিন লাখ! কিন্তু সত্যিকার অর্থে বার্গম্যানের এ দাবির তুলনায় শহীদের সংখ্যা ছিল ১০ গুণ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।

এ চক্রটি নিজেদের ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকতে শুরু থেকেই পরিকল্পিতভাবে শহীদের সংখ্যা কমিয়ে বলার চেষ্টা করে আসছে। ডেভিড বার্গম্যান তাদের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিচারাধীন বিষয়ে উস্‌কানি ছড়ানোর দায়ে একপর্যায়ে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ইতিহাস বিকৃতির দায়ে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাকে অভিযুক্ত করেন।

তার লেখার অন্যতম বিষয় হলো: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে আক্রমণ করা এবং দেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো। বর্তমানে নেত্রনিউজ নামে একটি সংবাদমাধ্যম খুলে বাংলাদেশ সরকার, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত এই বার্গম্যান।

কথিত এ সাংবাদিক নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করলেও তার ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিচয় সম্পর্কে জানা প্রাসঙ্গিক। তিনি ড. কামাল হোসেনের জামাতা। আর এই ড. কামাল বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় জোট বিএনপি-জামায়াতের প্রধান সমন্বয়ক। এ কারণেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে দীর্ঘসময় লেখালিখি করে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন বার্গম্যান।

এইচআরডব্লিউ: মানবাধিকার সংস্থার মানবাধিকার লঙ্ঘন

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই। সংস্থাটি মার্কিন সরকারের নীতির মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত বলে দাবি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক টাইমস বলছে, মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে এইচআরডব্লিউ সবসময় স্বচ্ছতা, সহনশীলতা ও জবাবদিহির চর্চা করে না। কোনো কোনো অঞ্চলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তারা সচেতনভাবে এড়িয়ে যায়।

নিউইয়র্ক সিটিভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ বহু পুরোনো। ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ায় মানবাধিকার সংকটকে ভুলভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিরুদ্ধে।

২০১৩ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তখনকার কৌঁসুলি তুরীন আফরোজ বলেছিলেন, বিবৃতি দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাইব্যুনালের মানহানি ঘটিয়েছে। সেই সম্মানহানির ঘটনাও মানবাধিকার লঙ্ঘন। একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল এইচআরডব্লিউ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই তখন বিবৃতি দিয়েছিল সংস্থাটি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাধারণ সম্পাদক জেড আই খান পান্না একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিবৃতির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যা মানবাধিকারের বিরুদ্ধে ও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের কথা।

পান্না বলেন, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এক জঘন্য মানুষ হচ্ছে গোলাম আযম। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে জাতিগতভাবে নির্মূলের জন্য সে নেমেছিল। এইচআরডব্লিউ একটি মানবাধিকার সংগঠন। একাত্তর সালে যাদের মানবাধিকার লুণ্ঠিত হয়েছে, তাদের প্রতিও এদের দায়িত্ব রয়েছে। তাহলে তারা কেন প্রমাণাদি সংগ্রহে সহযোগিতা করল না? পৃথিবীর অন্যতম বড় একটা যুদ্ধাপরাধ এখানে হয়েছে, সেটা কি তারা জানে না?’

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৫ সালে যখন জঙ্গিরা দেশব্যাপী বোমা হামলা করেছে, তখন তো তাদের এ রকম উদ্বেগ দেখিনি। ঝালকাঠিতে বিচারককে হত্যা করা হলো, সিলেটে আদালতে হামলা হলো, তখন তারা কোথায় ছিল? আর এখন এসে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে কেন?’ 

২০০৯ সালে সৌদি আরবের ধনীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে দেশটি সফরে যায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিনিধিদল। ওই সময় সৌদির মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো বক্তৃতা করার সুযোগই পাননি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তখনকার মুখপাত্র সারাহ লিয়াজ হোয়াইটসন।

বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সেসব দেশের একটি সৌদি আরব। সেই দেশ থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টার ঘটনায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমালোচনা করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সৌদিতে সবচেয়ে বেশি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তা নিয়েও কোনো বক্তব্য দেননি হোয়াইটসন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, মানবাধিকারের জন্য নয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্য টাকা তুলেছেন তিনি।

মানবাধিকার নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দ্বিমুখী নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনা হয়েছে। ভেনেজুয়েলায় রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে মানবাধিকারের বেশ ধরে নতুন অর্থনীতির মডেলের দেশগুলোর বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

এ ছাড়া ২০০৯ সালের ৮ জুলাইয়ের পর থেকে হন্ডুরাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে না থাকার নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, কলোম্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ৯৩ পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিনা বিচারে আটক, হামলা ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

ইয়েমেনে নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ নিরপরাধ লোকজনকে হত্যা করলেও সৌদি আরবের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা নিয়ে এইচআরডব্লিউকে কখনো মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।

টাইম সাময়িকীসহ উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই একমত যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শুধু নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী বা দলের মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করার কারণে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।

‘কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততাবিহীন কাজ করার নীতি’ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সৌদি আরবের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনুদান নেয়ার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ও নার্ভ গ্যাস ব্যবহারের প্রমাণ আছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যা প্রকারান্তরে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণের পক্ষে সায় দেয়।

তাদের দেয়া সেই ঘোষণাটি পরবর্তী সময়ে শতভাগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। মিথ্যা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুরু হওয়া ইরাকযুদ্ধে ছয় লাখ অকারণ হত্যাকাণ্ডের দায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কখনোই স্বীকার করেনি।

অপারেশন ক্লিনহার্ট: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শুরু

বার্গম্যানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চলছে। দেশে গুম-খুন হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয় অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে। কথাটি বলেছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, বিচারবহির্ভূত হত্যার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে চলছে, যেটি শুরু হয় ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে।

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার যুক্তিতে ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করা হয়। ওই অভিযানে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে এরই মধ্যে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ওই অভিযানে পঞ্চাশের বেশি লোক হেফাজতে মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার সেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদ্‌রোগে আক্রান্তের ব্যাখ্যা দিত।

২০০৩ সালে বিএনপি সরকার ওই অভিযানে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে একটি আইন পাস করে, যা ছিল সংবিধান পরিপন্থি। অপারেশন ক্লিনহার্টের মূল নায়করাই এখন মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা সেজে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে।

নেত্রনিউজের তথ্যচিত্র ‘আয়নাঘর’ নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী যে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ, গুম করেছে, সেটা এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে।

কিন্তু ৩১ আগস্ট (বুধবার) তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির আয়োজনে গুম নিয়ে সভা করা হয়, আবার গুম হওয়াদের কয়েকজন ফেরত এসেছে। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন দাগি আসামি। বিএনপি দাগি আসামিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে কি না, সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন। ফিরে আসা বেশ কয়েকজন বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দাগি, পলাতক আসামি। আর বিএনপি বলে তারা গুম হয়েছিল।

মন্ত্রী বলেন, গুমের যে তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১০ জন এরই মধ্যে ফিরে এসেছে। আর কয়েকজন গুম হয়েছে ২০ বছর আগে। ২০ বছর আগে তো বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখন যারা হারিয়ে গেছে, তাদের তালিকাও দেয়া হয়েছে। এগুলো বলে দেশে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে।

গেল আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা আজ সবাই বলে। সবাই ভুলে গেছে, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে কত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে ওই অভিযান চালানো হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছিল খালেদা জিয়া। অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে যত্রতত্র যেখানে-সেখানে মানুষকে ধরে নিয়ে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে যাকে যেখানে পেয়েছে নিয়ে হত্যা করেছে। আর সেই হত্যার বিচার হবে না।

বিএনপির শেকড়েই নিহিত রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। হাছান মাহমুদ জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যায় জিয়াউর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা তারাই করেছিল, যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, তার পরিবারকে হত্যা আসলে দেশের স্বাধীনতাকে হত্যাচেষ্টার শামিল।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়; যাতে বিচার না হয়, সেই লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনে একটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করা হয়েছিল।

বিএনপির বিচারবহির্ভূত হত্যার নজির

২০০৪ সালে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মহিম উদ্দীনকে হত্যার ঘটনা সম্পর্কে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ওই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী সাজ্জাদ হোসাইন সাজ্জাদ। সোমবার (২৯ আগস্ট) সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি পোস্টটি দেন। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

‘২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর। বিকেল আনুমানিক ৪টা। রাজনৈতিক এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ শেষ করে চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ীস্থ কামাল গেট বাজার এলাকায় রিকশার জন্য অপেক্ষমাণ ছিলাম। এমন সময়ে হঠাৎ র‌্যাব-৭-এর দুটি গাড়ি এসে আমাকে ঘেরাও করে টেনে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর আমাকে ওই গাড়িতে করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষমাণ থাকার পর বিমানবন্দর থেকে র‌্যাব-৭-এর ওই ফোর্স গাড়িতে তুলে নেয় তৎকালীন বর্ষীয়ান ছাত্রলীগ নেতা সাবেক এমইএস কলেজের ভিপি মহিম উদ্দীন ভাইকে। এরপর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। যখন রাত গভীর হয়, তখন আমাদের দুজনকে চট্টগ্রাম নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে নিয়ে আসা হয়। তখন জোট সরকারের নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন কর্নেল এমদাদ ও হাসিনুর রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে আমাদের দুজনকে এক লিটারের দুই মিনারাল ওয়াটারের বোতল দিয়ে ওজু ও কালেমা পড়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে।

পরবর্তীতে আমাকে র‌্যাব-৭-এর সৈনিকরা মাঠের একপাশে নিয়ে যেতে চায়, আমি যেতে অপারগতা প্রকাশ করায় সবাই মিলে আমার ওপর তাদের পায়ে থাকা বুট জুতা দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে টেনেহিঁচড়ে মাঠের একপাশে নিয়ে যায়। কর্নেল এমদাদের নির্দেশে মহিম ভাইকে মাঠের মাঝখানে নিয়ে যায় র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক হাসিনুর রহমান। মাঠের মাঝখানে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এবার হাসিনুর এসে কর্নেল এমদাদকে বলে কাজ শেষ স্যার! তখন আমি বুঝতে পারি মহিম ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তখন হাসিনুর আমাকে মাঠের মাঝখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্ত হঠাৎ করে কর্নেল এমদাদের মোবাইলে কল আসায় তিনি হাসিনুরকে দাঁড়াতে বলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন ও কোন কলেজের নেতা?

তখন হাসিনুর বলল এটা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। তখন কর্নেল এমদাদ বলল, ওপর থেকে দুজনকে একসঙ্গে মারার নির্দেশনা আসেনি। একে র‌্যাব-৭-এর হেড অফিসে নিয়ে যাও। আগামীকাল তার ব্যবস্থা করা হবে এবং পরবর্তীতে মহিম ভাইয়ের লাশকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। র‌্যাব-৭-এর সংগ্রহে থাকা কিছু আগ্নেয়াস্ত্র তার লাশের পাশে ফেলে দেওয়া হয়।

পরের দিন জোট সরকারের নির্দেশনায় পত্রিকায় নিউজ করা হয় দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মহিম নিহত হয়। কিন্ত যে হত্যা করার সময় আমি নিজে ওই স্থানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিলাম, তৎকালীন জোট সরকারের বাহিনী সেটিকে দুই পক্ষের গোলাগুলি বলে চালিয়ে দেয়। এটি ছিল তৎকালীন জোট সরকার এর আমলের ছাত্রলীগ নিধনের একটি চিত্র মাত্র।

নিউজ হওয়ার পরবর্তীতে ঢাকা থেকে অনেক সিনিয়র সাংবাদিক চট্টগ্রাম র‌্যাব-৭-এর হেড অফিসে যায়। তাদের মধ্যে আমি মুন্নী সাহাকে চিনতে পারি। আমাকে এর পরবর্তীতে র‌্যাব-৭-এর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। এর পরে আমাকে চেয়ারে হাত এবং পা বেধে রেখে প্রায় ১১ দিন আমার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। যখন আমার পরিবার থেকে আমার খোজ নেওয়ার জন্য র‌্যাব-৭-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তখন তারা আমাকে আটক করার বিষয়টি অস্বীকার করে। তখন আমার পরিবার থেকে এবং চট্টগ্রামের সিনিয়র আওয়ামী নেতারা নেতারা তৎকালীন মেয়র আমার নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তখন উনি র‌্যাব-৭ অফিসে ফোন করে হুঙ্কার দিয়ে বলেন বিচার বহিভূর্তভাবে মহিমকে হত্যা করেছেন আপনারা আর কোন ছাত্রলীগ নেতাকে যদি হত্যা করেন সেটার দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। আর যদি সাজ্জাদের নামে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে স্থানীয় থানায় দ্রুত স্থানান্তর করুন সাংবাদিক সম্মেলন করে। দীর্ঘ ১২ দিনের মাথায় আমাকে অবশেষে ডবলমুরিং থানায় স্থানন্তর করা হয়।

বর্তমানে যেসব মানবাধিকার নামে টাকার দোকানদাররা বর্তমান সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দিয়ে বেকায়দায় ফেলতে ছাচ্ছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন তখন আপনারা কোথাই ছিলেন?

২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর গ্রেপ্তারের দিন থেকে চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি থানায় আমার নামে ২৪টি মামলা দায়ের করে। এরপরে সাবেক মেয়র আমার নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর একান্ত চেষ্টায় এবং সকলের দোয়ায় দীর্ঘ তিন বছর পর কারামুক্তি লাভ করি।’