বগুড়া

দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে এসি ল্যান্ডের প্রত্যক্ষ মদদে চলছে সীমাহীন ঘুষ ও দুর্নীতি অসহায় সেবাপ্রাথীরা

কুদ্দুস তালুকদার দুপচাঁচিয়া (বগুড়া)

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ১১:৫১ এএম, ১৮ মে ২০২২ বুধবার

প্রতীকি ছবি

প্রতীকি ছবি

কুদ্দুস তালুকদার দুপচাঁচিয়া (বগুড়া): দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে উৎকোচের টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবা গ্রহীতারা। নামজারি ও মিস কেসের নামে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি আর ঘুষবাণিজ্য। এ অফিসে সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলছে এসি ল্যান্ডের নিজস্ব সিষ্টেমে সীমাহীন অনিয়ম, ঘূষ এবং স্বেচ্ছাচারিতা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা মাফিক উৎকোচ দেয়ার পরও কাজ হয় না। ভূমি মালিকরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও 

এসিল্যান্ডের উৎকোচের দাবি পূরণে অসমর্থ হলে পাওয়া যাচ্ছে না ভূমি অফিসের কাংখিত সেবা। নামজারি ও মিস কেসের নামে চলছে মোটা অঙ্কের ঘুষবাণিজ্য।

 উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের সেবা গ্ৰহীতাদের সঙ্গে  কথা বলে ও খোঁজ খবর  নিলে বেরিয়ে আসে ঘুষ, দুর্নীতি আর বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র। নামজারির আবেদন থেকে শুরু করে নামজারির প্রস্তাব, সার্ভে রিপোর্ট, নামজারি, ডিসি আর সংগ্রহ করে নামজারি সম্পন্ন করাসহ সব কিছুতেই ঘুষ আর ঘুষ। এসি ল্যান্ডের ঘুষের সাঙ্কেতিক চিহ্ন হচ্ছে (এল আর)। এসিল্যান্ড তার ঘুষের অঙ্ক বসান ইচ্ছামাফিক। সেই হারে ঘুষের টাকা দিলে নামজারি হয়। আর টাকা না দিতে পারলে নামজারি ফাইল পড়ে থাকে মাসের পর মাস।

মিস কেসের ক্ষেত্রে মিলেছে ভিন্ন রকম তথ্য, কেউ মিস কেস করে চার-পাঁচ বছর ধরে ধরনা দিচ্ছেন এসি ল্যান্ড অফিসে; কিন্তু কোনো সুরহা পাচ্ছেন না। উপজেলা ভূমি অফিসের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নামজারি সম্পর্কিত তথ্যবহুল বড় বড় ব্যানার বা লিফলেট চোখে ভেসে উঠবে। সেখানে লিখা রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সেবা দেয়ার কথা।

লিফলেটে লেখা রয়েছে, আবেদনের জন্য কোর্ট ফি ২০ টাকা, নোটিশ জারি ফি ৫০ টাকা, রেকর্ড সংশোধন বা হালকরণ ফি ১০০০ টাকা ও প্রতি কপি মিউটেশন খতিয়ান ফি ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে এক হাজার ১৭০ টাকা। কিন্তু ব্যানার বা লিফলেটে দেয়া নির্দেশাবলি ব্যানার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

খোঁজ নিয়ে মিলেছে ভিন্ন রকম তথ্য। প্রতিটি ডিসিআরের জন্য নেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন এক হাজার ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অভিযুক্ত কর্মকর্তা প্রতি পর্চা ও ডিসিআর স্বাক্ষর করতে ২০০ টাকা নিয়ে থাকে  এলআর নামক ঘুষ।

‘খ’ তফসিল জমির ক্ষেত্রে সরকার ২০১৩ সালে এক প্রজ্ঞাপনে অবমুক্তির একটি আদেশ দেন। সেই ‘খ’ তফসিল জমি এক থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খারিজ করতে এসি ল্যান্ড ঘুষ নেন ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা, এক থেকে ১৫ শতাংশ খারিজ করতে নেন ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা, এক থেকে ৩০ শতাংশ নেন ৪৫ থেকে ৬৫ হাজার টাকা, এক থেকে ৫০ শতাংশ নেন ৭৫ থেকে এক লাখ টাকা, এক থেকে ৭৫ শতাংশ নেন এক থেকে দেড় লাখ টাকা ও এক থেকে ১০০ শতাংশ নেন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। কাগজপত্রের একটু গরমিল হলে এক বিঘা খারিজ করতেই নেন দুই থেকে তিন লাখ টাকা। পার্ট ভিপি নামজারির ক্ষেত্রে একই হারে নেয়া হয় ঘুষ । ধর কষাকষির মাধ্যমে এ ঘুষের টাকা তিনি তার অধীনস্থ কর্মচারীদের মাধ্যমে আদায় করে থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানান, আমরা স্যারের অধীনে কাজ করি। স্যারের নির্দেশ আমাদের পালন করতে হয়।  উল্লেখ  যে,  এ্যসিল্যান্ড দুপচাঁচিয়া হিসেবে  জনাব আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসানাত যোগদান করেন ২০২০ সালে । দুপচাঁচিয়ায় যোগদান করেই তিনি শুরু করেন অবৈধ আর্থিক লেনদেনের কারবার। তিনি ৩৫ তম বিসিএসের একজন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা।

বিভিন্ন সুত্রে হতে ও ভুক্তভোগীদের মাধ্যমে জানা যায় যে, যেকোনো নামজারি-খারিজ সরকারি ফী -১১৭০ টাকা কিন্তু সেখানে  দুপচাঁচিয়া  উপজেলা ভূমি অফিসে নামজারি-খারিজ বাবদ নেয়া হয় সবনিম্ন ২৫০০ টাকা। মিস কেস, রেকর্ড সংশোধন বাবদ নেয়া হয় ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। সরকারি খাসজমি/ জলাশয় ইজারার ক্ষেত্রে প্রতি ডিসিআর বাবদ  ১০-৩০ হাজার টাকা। পুকুর খনন, মাটি ভরাট , বালু উত্তোলনকালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা কালে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সর্ব নিম্ন ফি নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়াও দুপচাঁচিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলা নাগর নদের আটালিয়া,জামতলা এবং ঘাসপুকুর এলাকা এবং সরকারি জমি  হতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলমান রয়েছে কিন্তু  এ্যসিল্যান্ড দুপচাঁচিয়া অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোপন আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে। এ্যসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে সদ্য যোগদান করা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা জানান যে , তিনি নতুন এসেছেন । সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের

এ ধরনের অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে  শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া তিনি বলেন, বিদায়ী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা উক্ত এ্যসিল্যান্ডের অনৈতিক কার্যক্রমের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছে। আমি এখন মনিটর করছি। সরকারি বিভিন্ন দফতরে তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অনেক অভিযোগ জমা পড়েছেন বলে জানান তিনি।

বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা যায় যে, উপজেলার মৌজা- আলতাফ নগর এর বাজার সংলগ্ন এলাকায় সরকারি ৩/৪ শতক জমিতে সাড়ে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে এ্যসিল্যান্ড পাকা দোকান ঘর তৈরিতে জনৈক নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কে মৌখিক সন্মতি দেন । কিছুদিন পর আরও দুই লাখ টাকা দাবি করে  গোবিন্দপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সহকারী মারফত খবর পাঠায় । কিন্তু ঐ ব্যবসায়ী টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তার নতুন ভাবে তৈরি করা ঘর ভেঙ্গে দেন উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী জনৈক ব্যক্তি মন্ত্রণালয় বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

জেলা প্রশাসনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজান বলেন,উক্ত কর্মকর্তার অবৈধ সুবিধা আদায় করে দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভূমি অফিসের পিয়ন ওবায়দুল নামের এক কর্মচারী কে অন্যায় ভাবে বরখাস্ত করেন । এ বিষয়ে  ভুক্তভোগী কর্মচারী  প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে আপীল করেছেন এবং উক্ত এ্যসিল্যান্ডের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এ্যসিল্যান্ড দুপচাঁচিয়া জনাব আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসানাত কতৃক  বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার মৌজা-দুপচাচিয়া , জে এল নং ৪৩ ,সাবেক দাগ নং ১৫১৭, হালদাগ ৬২২০ পরিমাণ ১৫ শতক ১/১ খতিয়ান ভুক্ত জায়গা ব্যক্তি স্বার্থে অবৈধভাবে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে ভূমি দূস্যদের অবমুক্ত করার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পাদান করেন জনাব

এ্যসিল্যান্ড দুপচাঁচিয়া,  উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী মতিয়ার রহমান মতি এবং  পিয়ন হুমায়ূন। উল্লেখ্য যে, দলিল, জেলা রেজিস্ট্রারের মতামত, আদালতের রায় মূল্যে জমির মূল মালিক রয়েছে একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং একজন হিন্দু কাঠ ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দুপচাঁচিয়া উপজেলার এ্যসিল্যান্ড  জনাব  আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসানাত ,  উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী মতিয়ার রহমান মতি এবং পিয়ন হুমায়ূনের যোগসাজশে ১৫ শতাংশ জমির মধ্যে ০৫ শতক জমির ভূয়া দলিল তৈরি করে মিস কেসের মাধ্যমে রেকর্ড করার প্রস্তুতি চলাকালে জমির মালিক আপত্তি জানিয়ে আবেদন করেন। দীর্ঘ দিনের হয়রানি শেষে জমির মূল মালিকগন  তাদের মালিকানার বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় এবং আদালত হইতে রায় পান । কিন্তু এ্যসিল্যান্ড

 দুপচাঁচিয়া তার অনৈতিক কাজ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে চলেছে। উক্ত জমির রেকর্ড না করে দিয়ে একেরপর এক তারিখ দিয়ে তাদের হয়রানি করছে । এমতাবস্থায় জনৈক বীরমুক্তিযোদ্ধা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক (মহিলা) উভয়েই এ্যসিল্যান্ড দুপচাঁচিয়া, 

জনাব আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসানাত এর বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যক্রম ও ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে একজনের জমি অন্যের নামে মালিকানা তৈরির কাজে সরাসরি সহযোগিতা করছে মর্মে (প্রমানসহ ) ভূমি মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খান সাহেব অভিযোগ করে বলেন, কিছু দিন আগে দুপচাঁচিয়া পৌর এলাকার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশরাফুজামান সাগর  দুপচাঁচিয়া পুরাতন বাজারের তার বাড়ি সংলগ্ন ১১ শতক খাসজমি দখল করে ৭ তলা বাড়ি নির্মান শুরু করে  এসিলান্ড কে উক্ত বিষয়ে বার বার বলার পরও কোন পদক্ষেপ নেয় নি। এছাড়াও মরাগাঙ্গি গোরস্থানের আশে পাশে বিপুল পরিমাণ খাস জমি দখল করছে বিভিন্ন মহল   এসিলান্ড আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে বলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

দুপচাঁচিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জনাব আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসানাত তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন এবং খাসজমি দখল সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কে ফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন, দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের অবৈধ কর্মকান্ড এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে  বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে  সত্যতা নিশ্চিত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক  ব্যবস্থা নেয়া হবে।