বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য বিশ্ব দরবারে

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৪:২০ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২২ শুক্রবার

সংগৃহীত

সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের প্রভাবে যেখানে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা সেবা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বর্তমানে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। 

বৈশ্বিক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে এখনো পর্যন্ত করোনার সংক্রমণরোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। সে যায়গায় বাংলাদেশে এরই মধ্যে প্রায় ৬ কোটি মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। 

গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত এক স্বাস্থ্য বুলেটিনে দেখা যায়- প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ কোটি মানুষ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা নিয়েছে এবং তাদের ৮০ শতাংশই সেবায় সন্তুষ্ট।
 
দেশে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা—এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি।

এ কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

টানা তিনবারের শেখ হাসিনা সরকার রাজধানী ঢাকা থেকে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম পর্যন্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে বিস্তৃত করেছে। এখন দেশের অনেক জেলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। অনুকূল পরিবেশে বেসরকারি পর্যায়েও গড়ে উঠেছে সাধারণ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে শুরু করে উচ্চমানের মধ্যম, তৃতীয় পর্যায় এবং বিশেষায়িত আধুনিক স্বাস্থ্য স্থাপনা। বিশ্বমানের জটিল অস্ত্রোপচারসহ প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এসব হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকসহ (গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদানের হার, শিশু ও মাতৃ মৃত্যু রোধ) প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অভাবনীয় সফলতা এসেছে।

তারা বলছেন, দেশের তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। একসময় বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা জেলা ও উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হয়েছে; যারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছেন। 

তারা আরো বলছেন, একসময় বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করা হতো। বর্তমানে ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হয়। তবে দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে জনবান্ধবমুখী করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ জনবল তৈরির ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারের বিষয়টিতে নজর দেয়া প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ের হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়টিতে খেয়াল রাখলে রাষ্ট্রীয় খরচ কমবে এবং সাধারণ মানুষ আরো কম খরচে চিকিৎসা পাবেন বলেও জানান তারা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. আনিসুর রহমান আনজুম বলেন, একুশ শতকের প্রত্যাশা’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপুষ্টি ও শিশুমৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান তালিকার শীর্ষে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানের ওপর সর্বশেষ যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ভিতরে বাংলাদেশের উপরে কেবল রয়েছে শ্রীলংকা। তাদের অবস্থান ৭৬ তম। ভারত ১১২ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১২২তম অবস্থানে। ভুটান ১২৪, মালদ্বীপ ১৪৭, নেপাল ১৫০ এবং সব থেকে পিছনে রয়েছে আফগানিস্তান, ১৭৩ তম অবস্থানে। এই র‌্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো বলেই প্রতীয়মান হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ মা ও শিশুর মৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। আর তার স্বীকৃতিও মিলেছে। বাংলাদেশ মা ও নবজাতকের টিটেনাস (এমএনটি) সংক্রমণ নির্মূলে সাফল্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি অর্জন করেছে। মাত্র এক দশক আগেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে মাতৃমৃত্যু হার শতকরা ৬৯ ভাগ কমেছে, যা এই ৬টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রগতি। এই সময়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি হাজারে ৮৮ জন থেকে কমে ৩৮ জন হয়েছে আর নবজাতকের মৃত্যুর হার ৪২ থেকে কমে ২৩ হয়েছে।

ডা. আনিসুর আরো বলেন, ২০০৭ সালে যেখানে শতকরা ২৩ জন নবজাতকের জন্মের সময় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সহায়তা নিতেন, এখন তা হয়েছে শকরা ৪২ ভাগ। মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য আছে। প্রতি এক লাখে ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৩৯৯ আর ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭৬ জনে। গড় আয়ু বিবেচনায়ও বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। আর এগুলো সব সম্ভব হয়েছে সরকারের যে প্রতিশ্রুতি “সবার জন্য স্বাস্থ্য” এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নের দৃশ্যমান চিত্রে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের যতগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ আছে। অনেক দেশে তার ধারে কাছেও নাই। যদিও এগুলোতে শিক্ষক সংকট চরমভাবে বিরাজমান। কাজেই পদ সৃষ্টি করে অতি সত্বর সেগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আর একটা জিনিস হাসপাতালে অনেক যন্ত্রপাতি সামান্য একটু মেরামতের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকে। সেটা ঠিক করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় এসব ক্ষেত্রে পরিচালক ও অধ্যক্ষকে যদি সরাসরি ঠিক করার জন্য বাজেট দেয়া থাকে তাহলে রোগীদের অনেক উপকার হবে। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতের মান বেড়েছে বলেই মানুষের সাহস বেড়েছে। করোনার সময় কেউ বাইরে যেতে পারেননি। সবাই দেশেই ছিলেন। কোভিড, নন-কোভিড সব চিকিৎসা দেশে হয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায় হাসপাতালের অবস্থা ভালো।

ভ্যাকসিনের প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত মোট ১৬ কোটি ডোজ করোনার টিকার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। আমরা শুধু ভ্যাকসিন আনছি না, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করা। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অতি দ্রুত দেশে ভ্যাকসিন তৈরি করা হবে। 

তিনি বলেন, এরই মধ্যে প্রায় ৬ কোটি টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আরো টিকা নিয়ে আসতে বলেছেন। আমরা কোভ্যাক্স থেকে ৫ কোটি টিকা পাব। সব মিলিয়ে ১৬ কোটি ভ্যাকসিনের অর্ডার আছে। ভ্যাকসিনকে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার কথা তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়- বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার কম। সেই তুলনায় আমরা বুঝতে পারি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন কেমন হয়েছে।