সালমা সিদ্দিকীর প্রথম গল্পগ্রন্থ: কালভ্রামক

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০২:৪৪ পিএম, ৩ জুলাই ২০২১ শনিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সালমা সিদ্দিকীর প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম কালভ্রামক। কালভ্রামক নামটা প্রথমবার শুনে ধ্বনিগত ঐক্যের কারণে কালোভ্রমর বলে ভ্রম হতে পারে। আবার ‘কাল’ শব্দটি কখনো মৃত্যুর কথাও মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এ গ্রন্থনামে ‘কাল’ মৃত্যুজ্ঞাপকও নয়। বরং জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি ঝুলে থাকে যে ম্লান আর উজ্জ্বল সময়, কালভ্রামক গঠিত হয় সেই যৌথ উদযাপনের টুকরো টুকরো রেণু নিয়ে।

সালমাও স্বীকার করেন সে কথা—‘গভীর আগ্রহ নিয়ে তাই সময় পর্যবেক্ষণ করি; জীবনই দেখি আদতে। এই দেখায় কখনো বিস্ময় জাগে, কখনো ঘোর লাগে আবার কখনো মর্মাহত হই কিংবা বিষাদগ্রস্ততাও পেয়ে বসে।’

কালভ্রামক মূলত সেই বিস্ময়াভিভূত, ঘোরলাগা জীবনের ভাষিক উন্মোচন। সালমা নিজের ভেতর নিজে একেবারে ডুবে থেকে গেঁথে তোলেন যাপিত জীবনের সারাৎসার—সেই যাপনের অন্তর্লীন অধিবাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায় আমাদের জনপদের নানা শ্রেণির নানা স্তরের মানুষের আনন্দ-বেদনার জার্নাল। ফলে, কালভ্রামক-এর গল্পগুলো আর নিছক গল্পের পরিবৃত্তে আটকে থাকে না—রক্ত-মাংস-স্বাদে তা হয়ে ওঠে দৃশ্যমান জীবনের ফাঁক গলে পড়ে যাওয়া অগোচরীভূত জীবনের আখ্যান।

সালমার সুতীব্র আগ্রহ ও একাগ্র মনোযোগে নির্মিত প্রতিটি গল্পের বিষয় এত অনায়াস আর অকপট হয়ে ওঠে যে, একটা বিশ্বাসের ঘেরাটোপ তৈরি হয়। কখনো মনে হয় না, এ বানানো গল্প—মনে হয়, এ জীবন তো আমিই যাপন করেছি বা এ গল্প আমার চেনা।

এই চেনা জীবনের গল্প-রূপকার সালমা কালভ্রামক-এ প্রথম গল্পগ্রন্থের স্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হন বটে কিন্তু গল্পে তিনি একেবারেই অভ্যাগত নন। বরং উনিশ বছরব্যাপী তার গল্প সৃষ্টির স্পর্ধিত সাধনার প্রকাশ ঘটে কালভ্রামক-এ।

কালভ্রামক-এ আছে দশটি বৈচিত্র্যপূর্ণ গল্প। জীবনায়নের দিক থেকে গল্পগুলোর পটভূমি ছড়িয়ে আছে গ্রামের নদী, মাঠ-ঘাট ও নগরের রাস্তায়, পার্কে, ইটের দালানের চার দেয়ালে—বলা যায় বাস্তব বাংলাদেশের আত্মাজুড়ে।

সূচনা গল্পের নাম ‘ভোর’। গ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পটি মূলত যৌন বহুগামী ফজর আলীর আধিপত্যে পীড়িত শরীফার রুখে দাঁড়ানোর আখ্যান। এতদিন দুর্বল ও নরম হয়ে থাকা শরীফা অবশেষে ফজরকে প্রতিরোধ করে জীবনে একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা করে।

‘মনের সুদূর পারে’ গল্পটিতেও দেখা যায় মুনা নামের মেয়েটি পিয়ালের বিস্তার করা দুরভিসন্ধি প্রবণ প্রেমের জাল কেটে বেরিয়ে বিশাল আকাশের নিচে খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। ‘পথের জার্নাল’ গল্পের শ্রাবণীও পুরুষের আধিপত্যকে অস্বীকার করে ‘সিঙ্গেল মাদার’-এর জীবন বেছে নেওয়ার সাহস অর্জন করে।

গল্পগুলোতে নারীর মানসিক-উত্থান, সাহসিকতার রূপায়ণে সালমাকে একজন নারীবাদী কথাশিল্পী মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি যে প্রচলিত নারীবাদী লেখক নন, কালভ্রামক-এর অন্য গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়।

‘বৃত্তমিথ’, ‘ছাতা’, ‘মেহন’, ‘রক্তবীজ’, ‘সংসার’, কিংবা ‘লিখতে থাকা কবিতার খসড়া’ গল্পে যে অন্ধকার-অনুভবের উপর আলো ফেলে প্রত্যক্ষ করান, মূলত মানুষের অদেখা জীবনের অসহ বেদনা ও অপ্রাপ্তির হাহাকার। ফলে, সালমা না নারীবাদী না পুরুষবাদী। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় স্বয়ং ঋদ্ধ সালমাকে বরং মানুষবাদী বলা ভালো। যদিও নিজে নারী বলে নারীর অন্তঃসত্ত্বা তার ভালো জানা। কিন্তু তার গল্পে পুরুষও বাস্তব ব্যতিরেকে, বিরুদ্ধাচরণ পায় না।

‘প্রিয়েমশন’ নামের গল্পটির কথা বিশেষভাবে বলতে হবে এজন্য যে, গল্পটি লেখকের শক্তিমত্তার সম্ভাবনাকে উসকে দেয়। একটি উপন্যাসকীয় বিস্তার নিয়ে রচিত গল্পটি ভবিষ্যতে সালমার কাছে উপন্যাসের প্রত্যাশা জাগিয়ে দেয়।

প্রথম গল্পগ্রন্থের সম্পূর্ণ পরিপক্বতা সত্ত্বেও একটি কথা বলতে হবে, সালমা বিষয়-বৈচিত্র্যে যতটা সমৃদ্ধ ভাষায় ততটা নন। কেবল ভাষায় নয়, নির্মাণ-প্রকৌশলের দিকেও তার মনোযোগ কম বলে মনে হয়। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, তিনি শখের গল্পকার নন বা তাকে পৃথকভাবে নারী লেখক বলে ব্র্যাকেট বন্দী করার সুযোগও নেই।

আশা করি, কালভ্রামক যোগ্য পাঠকের স্বীকৃতি পাবে এবং সালমা সিদ্দিকী বাংলা ভাষার একজন কথাকার হিসেবে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের সাহিত্যকে সমুন্নত করবেন।

কালভ্রামক গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জাগৃতি প্রকাশনী।