দুর্নীতিবাজ (অবঃ) কর্নেল শহীদকে সাধু বানানোর চেষ্টা কনক সারোয়ারের

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৯:০৮ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার

কনক সারোয়ার ও কর্নেল শহীদক (অবঃ)

কনক সারোয়ার ও কর্নেল শহীদক (অবঃ)

সম্প্রতি বিদেশে অবস্থানরত সাংবাদিক কনক সারোয়ার সাজাপ্রাপ্ত বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা (অবঃ) কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানের একটি স্বাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যে সাক্ষাৎকারটি শুরুই হয়েছিল অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে।

বিতর্কিত ও অভিযুক্ত কোন ব্যক্তির নিজের পক্ষে সাফাই দেয়া স্বাভাবিক তবে কনক সারোয়ার একজন সঞ্চালক হয়েও যেভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু করেছেন তাতে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যই অসৎ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

আসুন আমরা একে একে উন্মোচন করি এসব মিথ্যাকে

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই কনক সারোয়ার শহীদ উদ্দিন খানকে এই বলে পরিচয় করিয়ে দেন যে ২০০৫ সালে একটি উড়ো চিঠির ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনী তাকে বরখাস্ত করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তার প্রতি অবিচার করা হয়েছিল।

প্রথমত, উড়ো কোন টিঠির ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে কোন কোর্ট মার্শাল সম্ভব না। বাস্তবতা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে শতাধিক লিখিত অভিযোগ ছিল এবং এই অভিযোগগুলো করেছিলেন বিজিবির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তৎকালীন তার ক্ষমতার দাপটে সর্বশান্ত হওয়া ব্যক্তিরা। এদের মধ্যে তার পরিবারের লোকজনও রয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, তিনি আওয়ামী লীগের সরকার তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে অবিচার করেছে বলে উল্লেখ করেন কনক সারোয়ার। অথচ তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। যখন ক্ষমতায় ছিলো বিএনপি।

এরপর ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখনও তিনি বরখাস্ত অবস্থাতেই সম্পত্তি দখল, প্রতারণা, মানি লন্ডারিং ডেসটিনির টাকা পাচারের মতো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালেই তিনি বিদেশে পারি জমান।

অথচ কনক সারোয়ার তাকে সরকারের বিরুদ্ধে একজন সৎ সাহসী সৈনিক হিসেবে দর্শকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।

আসুন আমরা দেখে নিই তিনি কতাটা সৎ!

অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন বর্তমানে বিশাল সম্পত্তির মালিক। তিনি স্ত্রী কন্যাসহ লন্ডনে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন কিন্তু বিলাসিতা করার মতো টাকা তিনি কিভাবে কামিয়েছিলেন?

কর্নেল (অবঃ) শহীদ উদ্দিন খান ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০২ সালে জাতিসংঘ মিশনে তাকে কঙ্গোতে পাঠানো হয়। কিন্তু ২ মাস পরই দেশে ছুটিতে এসে শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মিশন হতে নাম প্রত্যাহার করান এবং অধিনায়ক হিসেবে ৩০ রাইফেল ব্যাটালিয়নে বদলী গমন করেন। রহস্যজনকভাবে এই নাম প্রত্যাহারের কারণটি আমরা শেষে জানবো।

রাজশাহী সেক্টরের অধীনস্থ তৎকালীন ৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন চাঁপাইনবাবগঞ্জে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর হতে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ পর্যন্ত বিডিআর সদর দপ্তর, পিলখানায় একটি কোর্ট মার্শাল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন অনিয়মের প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ২৮টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। যার কোনটাই উড়ো চিঠি ছিল না।

কোর্ট মার্শালে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরও সরকারের বিশেষ বিবেচনায় কর্নেল পদবীতে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রাপ্ত হন এবং নিয়মিত অবসর গ্রহণ করেন।

কিন্তু এরপর একে একে বের হয়ে আসে তার বিভিন্ন অপকর্ম। সর্বশেষ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সেনানিবাসে অবাঞ্চিত হন।

ব্যবসায়িক জীবন
প্রথমত, কুমিল্লায় শ্বশুরের মালিকানাধীন বন্দিশাহী নামের নাম সর্বস্ব পরিত্যক্ত কোল্ড স্টোরেজ কয়েক গুণ বেশি দামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানী ডেসটিনির কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির কাউকে এই টাকার ভাগ দেননি।

ডেসটিনি-২০০০ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন এর সাথে অবৈধ মানি লন্ডারিং ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। ডেসটিনির পাচারকৃত কোটি কোটি টাকা যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছেন। ফলে ডেসনিনিও বেশি দাম দিয়ে পরিত্যক্ত কোল্ড স্টোরেজ কিনতে আপত্তি করেনি।

এছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের অবৈধ টাকাকে বৈধতা দিতে এবং যুক্তরাজ্যে তা বিনিয়োগে সহায়তা করতে তিনি রফিকুল আমিনের নিকট হতে বিরাট অংকের টাকা ঘুষ নেন ও দুজন মিলে অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের কাজে জড়িয়ে পড়েন।

২০০৯ সালে তার স্ত্রী ফারজানা আনজুম, কন্যা- শেহতাজ মুনাসি খানসহ মোট ৫ জনের বোর্ড অব ডাইরেক্টরস বানিয়ে প্রচ্ছায়া লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি চালু করেন।

কোম্পানীটিতে নিজস্ব সেটআপ এর মাধ্যমে বেনামী, মামলাযুক্ত, ঝামেলাপূর্ন, বিবাদমান এবং অবৈধ জমি নিজ/বেনামে ক্রয়-বিক্রয় এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। আর এজন্য তিনি তার সেনা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে প্রভাব খাটাতেন।

তার শ্বশুর বাড়িতে গাজিপুর হাউস কমপ্লেক্স নামে ৫ তলা বিল্ডিং করেন শ্যালকের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে। অথচ শ্যালক কাজী মশিউর রহমান ও তার শ্বাশুড়িকে বঞ্চিত করে নিজ স্ত্রী-সন্তানদের নামে বাড়িটি ভাগ বাটোয়ারা করে দেন।

রাজনৈতিক সংযোগ
২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে বিএনপি দলীয় নেতা কর্নেল অলি আহমেদ এর সঙ্গে পরিচয় হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ এর যোগসাজশে কর্নেল অলিকে যেকোন মূল্যে বিজয়ী করার কাজে সাহায্য করেন শহীদ উদ্দিন খান।

সংশ্লিষ্ট ব্রিগেড কমান্ডারের পূর্বানুমতি ছাড়াই ওই নির্বাচনী এলাকা থেকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিভিন্ন ভুয়া অস্ত্র মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে হেনস্থা করতেন।

এ বিষয়টি অবগত হয়ে তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার তাকে অভিযানের নামে হয়রানি করতে নিষেধ করেন এবং তৎকালীন জিওসি, ২৪ পদাতিক ডিভিশন মহোদয়কে অবহিত করেন।

তাছাড়া, সেনা নিয়ম ভঙ্গ করে নির্বাচনের দিন বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাতকার প্রদান করেন। এক পর্যায়ে কর্নেল শহীদের অপ তৎপরতায় বিষয়টি আরও উর্ধ্বতন পর্যায়ে গড়ায় এবং জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়।

৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নে যোগদানের অব্যবহিত পরেই ৩-৬ জুন ২০০৪ তারিখের মধ্যে তৎকালীন ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ডিজি বিডিআর, প্রধান মন্ত্রীর সামরিক সচিৰ (এমএসপিএম) ও বিডিআর এর পরিচালক প্রশিক্ষণ (ডিওটি) এর বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিকট বেনামী পত্রের মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি উচ্চ পদস্থ সামরিক ও অসামরিক কার্যালয়ে এর অনুলিপি প্রদান করে সেনা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেন এবং সুস্পষ্টভাবে সেনা আইন লঙ্ঘন করেন।

এই কর্মকর্তা রাজশাহী সেক্টরের অধীনস্ত তৎকালীন ৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন, চাপাইনবাবগঞ্জে কর্মরত থাকাকালে সীমান্তে একটি শক্তিশালী চোরাকারবারী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। বিএনপি’র প্রভাবশালী নেত্রী সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ এর প্রত্যক্ষ মদদে চাপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আহমেদ উল্লাহর যোগসাজশে এ সিন্ডিকেট করেন।

শহীদ উদ্দিন খান ৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধীনস্থ সোনা মসজিদ ও চকপাড়া সীমান্ত পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি দুটি সোনা মসজিদ স্হলবন্দরের সন্নিকটস্থ হওয়ায় সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়াকে ভারতে অবৈধ জিনিসপত্র চোরাচালানের উদ্দেশ্য অনৈতিক সুবিধা প্রদান করতেন।

তৎকালীন রাজশাহী বর্ডার গার্ড সেক্টর কমান্ডার এসব অনিয়মের বিষয়ে শহীদ উদ্দিন খানকে মৌখিকভাবে সতর্ক করতে গেলে তার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।

শহীদ উদ্দিন খান ৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন কর্তৃক উদ্ধারকৃত অবৈধ মালামালের ১০-৩০ শতাংশ সোর্সকে প্রদানের কথা বলে স্টোরে সংরক্ষিত রাখতেন, যা পরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে তার অর্থ আত্মসাৎ করতেন।

তাছাড়া, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বেশ কয়েকবার ব্যাটালিয়নের সীমানার মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন ধরণের বিশালাকৃতির গাছপালা বিক্রয় করে তার অর্থ আত্মসাৎ ও কিছু গাছ দিয়ে তার ব্যক্তিগত ফার্নিচার তৈরি করেন।

তার সময়ে কয়েকশ কোটি টাকার মাল জব্দ করা হলেও তিনি স্টোরের চাবি নিজের কাছে রাখতেন এবং রাতের আঁধারে স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে পাচার করে দিতেন। এ ক্ষেত্রে কেউ তার অনুগত না হলে তাকে শাস্তি প্রদান করতেন।

এ কর্মকর্তা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে চাকুরিস্থলের অর্থাৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ এর স্থানীয় সাংসদ ও বিএনপি নেতা হারুন-উর-রশীদ এবং তার স্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া’র সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন।

সীমান্তে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য হারুন তার স্ত্রীর মাধ্যমে এই কর্মকর্তাকে হাতে নিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে পাপিয়ার সাথে তার অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং বিষয়টি ব্যাটালিয়নসহ স্থানীয়ভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়। এমনকি এ নিয়ে পাপিয়ার স্বামী হারুনের সাথে পাপিয়া ও এ কর্মকর্তার বাক-বিতন্ডা হয়।

উল্লেখ্য, তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সাথে চাকরীচ্যুত এ সেনা কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় তিনি যেকোন অবৈধ কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতেন।

২০১৮ সালে তার বাসায় কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রাসন্যাশন্যাল ক্রাইম (সিটিটিসি) কর্তৃক বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক, অবৈধ অস্ত্র (২টি বন্দুক, ২টি শটগান) উদ্ধার করে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদরাসা ও ইসলামি শিক্ষার প্রসারের আড়ালে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ তার ৫৪টি ব্যাংক আকাউন্টের খোঁজ পেয়েছে।

উল্লেখ্য, কর্নেল (অবঃ) শহীদ উদ্দিন খান গত ১০ বছরে ভূমি জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছেন। এ অভিযোগে একটি জালিয়াতি মামলায় আদালত তার অনুপস্থিতিতে ৫ বছরের সাজা ঘোষণা করে।

কর্নেল (অবঃ) শহীদ অদ্যবধি কোন মামলায় স্বশরীরে হাজির না হয়ে লন্ডনে অপরাধের কারণে ইন্টারপোল থেকে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি রয়েছে।

বৈদেশিক জীবন-যাপন

কর্নেল (অবঃ) শহীদ উদ্দিন খান ২০০৯ সালের নভেম্বরে যুক্তরাজ্যে থাকা শুরু করেন। সেখানে রেসিডেন্ট পারমিট পেতে আনুমানিক ১৮ লাখ পাউন্ড বিনিয়োগ করেছেন। এতগুলো টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়া হয়নি।

দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের উইম্বলডনে পরিবারসহ বসবাস এর মাধ্যমে শহীদ এই অঞ্চলের ক্ষমতাসীন এমপি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডকে ২০ হাজার পাউন্ড অনুদান দেন।

শহীদ উদ্দিন খান দুবাইতে আল আথির স্টার টেকনিক্যাল সার্ভিসেস্ এলএলসি তে বিনিয়োগকারী হিসেবে বসবাসকারী (রেসিডেন্ট পারমিট) হিসেবে ১০ বছরের জন্য ভিসা পারমিট বাবদ ১০ মিলিয়ন আরব আমিরাত দিরহাম (এইডি) বিনিয়োগ করেন