কৃষি খাতে যন্ত্র ব্যবহারে সুফল কৃষকের ঘরে
নিউজ ডেস্ক

কৃষি খাতে যন্ত্র ব্যবহারে সুফল কৃষকের ঘরে
দেশের কৃষি খাতে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। সনাতন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এখন আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণের দিকে হাঁটছে কৃষি। এ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস; ফসলের নিবিড়তা (জমির চাষযোগ্যতা) বৃদ্ধি, শস্যের গুণগতমান বৃদ্ধি, সময়, শ্রমদক্ষতা ও অর্থের সাশ্রয়সহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ রাখছে বিরাট ভূমিকা। গত তিন বছরে শুধু ধান কাটতে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার বাড়ছে প্রায় ২ হাজার শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে কম্বাইন হারভেস্টারে ধান কাটার ফলে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কৃষকের ২৭.১৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সম্প্রতি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ওপর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এই প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করেছে। ২০২০ সালে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’টি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবেদনে প্রকল্প গ্রহণের আগে ও পরের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে ধান কাটা, রোপণ, মাড়াইসহ অন্যান্য কাজে যন্ত্রের ব্যবহার ছিল খুবই কম। বিশেষ করে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের শুরুর আগে ২০১৯ সালে দেশে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো মাত্র ৪ শতাংশ। প্রকল্পটি গ্রহণের পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে যন্ত্রটি দিয়ে ধান কাটা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৯০ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে গত বোরো মৌসুমে নেত্রকোনায় ৭১ শতাংশ, মানিকগঞ্জে ৭০ শতাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬০ শতাংশ, দিনাজপুরে ৫২ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫২ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৫২ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৫০ শতাংশ, নোয়াখালীতে ৫০ শতাংশ, ভোলায় ৪৭ শতাংশ, সুনামগঞ্জে ৪১ শতাংশ এবং পটুয়াখালীতে ৪১ শতাংশ জমির ধান কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে কাটা হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্প শুরুর আগে ২০১৯ সালে ধান রোপণের যন্ত্র রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের ব্যবহার ছিল ১ শতাংশের নিচে। কিন্তু বর্তমানে এ যন্ত্রের ব্যবহার করে প্রায় ৬ শতাংশ ধান রোপণ করা হচ্ছে। প্রকল্প শুরুর পর রিপার যন্ত্রের ব্যবহার ১৮৫ শতাংশ, সিডার যন্ত্রের ব্যবহার ৬৯৭ শতাংশ, মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার ১৯৩ শতাংশ, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের ব্যবহার ৬১ শতাংশ, মেইজ শেলার যন্ত্রের ব্যবহার ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশ, ফসলের সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ হয়েছে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস পেয়েছে ৪৫.২৫ শতাংশ, যা প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ক্রমেই কৃষিতে বাড়ছে ঝুঁকি। এ অবস্থায় কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়ন করতে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ওপর আরও বেশি জোর দিতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষক কম সময়ে ফসল ঘরে তুলতে পারছে। পাশাপাশি কৃষকের কমেছে অমানবিক ও কায়িক শ্রম। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন শিলাবৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া, আকস্মিক বন্যা থেকে ফসল রক্ষার পাশাপাশি কমেছে উৎপাদন খরচ। সংগ্রহোত্তর অপচয় কম হওয়ায় কৃষক বেশি ধান পাচ্ছেন। এতে বাড়ছে কৃষকের লাভের পরিমাণ।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। সারাদেশে ৫০ শতাংশ ও হাওর-উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পটি তৃতীয় বছর অতিক্রম করেছে। প্রকল্পের ডিপিপিতে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ৫০০টি উপজেলায় পাঁচ বছরে ১২ ক্যাটাগরির ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্র সরবরাহ করার সংস্থান রয়েছে।
প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে প্রায় ৩৩ হাজার ৩৬০টি কৃষি যন্ত্র কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার ৮ হাজার ৪৬৭টি, রিপার ২ হাজার ১৯৬টি, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ৩৩০টি, পাওয়ার ট্রিলারচালিত বেড প্লান্টার ও সিডার ১১ হাজার ৮৯৪টি, পাওয়ার থ্রেসার ৮ হাজার ৫৮টি, মেইজ শেলার ১ হাজার ১৯৫টি, পাওয়ার স্প্রেয়ার ১৫২টি, পাওয়ার উইডার ২৭টি, পটেটো ডিগার ১ হাজার ৮টি ও ড্রায়ার ৩৩টি। যন্ত্রগুলোর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, এক একর জমির ধান কাটতে শ্রমিকের প্রয়োজন কমপক্ষে ৯ জন। শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা হলে এক একর জমির কর্তন খরচ ৫ হাজার ৮০০ টাকা। কর্তনকৃত এক একর জমির ধান বহন করে প্রেসিং ফ্লোরে আনতে শ্রমিকের প্রয়োজন ৬ জন। এতে খরচ ৩ হাজার ৬০০ টাকা। মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে এক একর জমির ধান মাড়াই করতে প্রয়োজন ৩ জন। এত খরচ ১ হাজার ৮০০ টাকা। ঝাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে এক একর জমির ধান ঝাড়াই করতে খরচ লাগে এক হাজার টাকা। অতএব, সনাতন পদ্ধতিতে এক একর জমির ফসল কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই বাবদ খরচ পড়ে ১১ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যদিকে, কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে এক একর জমির ফসল কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই বাবদ খরচ পড়ে ৫ হাজার ৪০০ টাকা। এক একর জমির ধান ট্রলিতে করে পরিবহন বাবদ খরচ পড়ে ৬০০ টাকা। মোট হয় খরচ ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে এক একর জমির ধান ঘরে তুলতে কৃষকের খরচ কমছে মোট ৫ হাজার ৮০০ টাকা।
এ ছাড়া কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা ধান কাটার ফলে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় ১০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে কমে এসেছে। ফলে কৃষক ৮ শতাংশ ধান বেশি পাচ্ছে। হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ৫.৫ টন হলে ৪৪০ কেজি ধান কৃষক বেশি পাচ্ছে। ধানের মূল্য ২৫ টাকা কেজি হলে প্রতি হেক্টরে কৃষক বেশি পাচ্ছে ১১ হাজার টাকা, যা একর প্রতি ৪ হাজার ৪৫৪ টাকা।
প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫৯.৬৬ শতাংশ। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি বা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যে বিপ্লব শুরু হয়েছে তা অনেক দূর যাবে। প্রকল্পটি শুরুর আগে কৃষকের ভাবনায় ছিল না, যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা যায়। প্রকল্প শুরুর প্রথমদিকে কৃষক তার ক্ষেতে যন্ত্র নামাতেই দিতেন না। অথচ যন্ত্র কেনার বিষয়ে তাদের আগ্রহ এখন অনেক বেশি। আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী যন্ত্র দিতেই পারছি না। কৃষকের মাঝে যন্ত্রের এই চাহিদার বিষয়টি প্রকল্পের সফলতা হিসেবে দেখছি।
যান্ত্রিকীকরণে অন্যান্য অগ্রগতি : এই প্রকল্পের কারিগরি কমিটির পরামর্শক্রমে আনসার এনার্জি লিমিটেড বাংলাদেশে প্রথম কম্বাইন হারভেস্টার তৈরি করে। উন্নয়ন সহায়তায় বিতরণকৃত ৩৩ হাজার ৩৬০টি কৃষি যন্ত্রের উপকারভোগীদের নাম, মোবাইল নম্বর, ইঞ্জিন নম্বর ও চেসিস নম্বরসহ একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে ১০৭ ব্যাচে ৩ হাজার ২১০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ২৮ দিনব্যাপী আবাসিক ও গ্রামীণ মেকানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকার যুবকদের দক্ষ মেকানিক কাম ড্রাইভার তৈরির পাশাপাশি ভর্তুকির মাধ্যমে কম্বাইন হারভেস্টার নিয়ে দক্ষ চালক ও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। যন্ত্র উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন কৌশলের ওপর ৩০ ব্যাচে ৭৫০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্রেতে চারা তৈরি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০টি উপজেলায় ৩০০টি অটো রাইস সিড সোয়িং মেশিন এবং ৬ লাখ ট্রে চারা উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে খুচরা যন্ত্রাংশের চাহিদাও বাড়ছে। কৃষি যন্ত্রপাতি কারিগরি কমিটির তত্ত্বাবধানে ১২ ধরনের যন্ত্রের ৩০০টি মডেল মাঠ পরীক্ষা শেষে তালিকাভুক্ত হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কৃষক তার পছন্দ অনুযায়ী ভালোমানের কৃষি যন্ত্র উন্নয়ন সহায়তায় ক্রয় করতে পারছে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। এ কর্মসূচিতে সরকার যে টাকা দিচ্ছে তা সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। সরকার অর্ধেক ভর্তুকি দিলেও কৃষকের পক্ষে এত টাকা দিয়ে যন্ত্র কেনা সম্ভব না। এ জন্য সার্ভিস প্রোপ্রাইটর তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে কৃষক এক সেন্টার থেকে জমি চাষ, ধান লাগানো এবং ধান কাটার সেবাটা একসাথে পেতে পারে। তিনি বলেন, যান্ত্রিকীকরণকে একধাপ এগিয়ে নিতে কৃষকদের অল্প সময়ে তার লাভটা বুঝিয়ে দিতে হবে। এ জন্য সরকারকে যান্ত্রিকীকরণের আরও বেশি জোর দিতে হবে।
- বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য বিশ্ব দরবারে
- বঙ্গবন্ধুর সাথে ছোট বেলার স্মরণীয় মধুর স্মৃতি
- অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার এক অনুপম দৃষ্টান্ত: মুরাদ হাসান
- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন আজ
- কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার
- ভারতের নতুন হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বাংলাদেশে
- বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ হবে বাংলাদেশে, দৈর্ঘ্য ২৫০ কি.মি.
- কৃষিপণ্য কেনাবেচার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর ন্যাশন’ উদ্বোধন করে
- হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা সমগ্র মানব জাতির জন্য অনুসরণীয়: রাষ্ট্রপতি