ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এই কি তাহলে রাজনীতির ভাষা?

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:০৭, ২৫ মে ২০২৩  

এই কি তাহলে রাজনীতির ভাষা?

এই কি তাহলে রাজনীতির ভাষা?

রাজনীতিবিদরা ভাষার কারবারি। একটু হোচট খেলে লাভ-লোকসানের হিসাবে টান পড়ে। অথচ রাজনীতির খেলাটা মিছরির ছুরির মতোও হতে পারে। মধুর ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নজিরও কম নেই। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা কিংবা কথোপকথনের বিষয়টি স্মরণ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর সুললিত ভাষা তাকে জনসম্পৃক্ত করেছে।

আবার অত্যাচারী শোষকের প্রতি তার কঠোর সুরেও কমতি ছিল না। আমরা স্মরণ করতে পারি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে স্পষ্ট বললেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু করবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ দমাতে পারবে না।’ কী কঠোর বার্তা তার ভাষায়। কিন্তু শালীনতা ছিল প্রতিটি শব্দে। কঠোর সাবধান বাণীর কমতি ছিল না সেই ভাষ্যে। অথচ তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাঙালি প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।

তারও আগে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলে ইতিহাসের ভাষা সৃষ্টি করলেন। মওলানা সাহেবের একটি সালামও কঠোর বারতা হিসেবে কম যায় না। কিন্তু সেই রাজনৈতিক ভাষা যখন কবরে পাঠানো, হত্যা করো, পুঁতে ফেলো জাতীয় হয়ে পড়ে তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিই প্রশ্নের মুখে পড়ে। সেখানেও আদর্শ কিংবা কর্মসূচিকে আক্রমণ করা আর ব্যক্তিকে আক্রমণ করার বিষয়টিও আলোচনা হতে পারে। কোনো রাজনীতিবিদ হয়তো প্রতিপক্ষের আদর্শিক কোনো বিষয়কে কবরে পাঠানোর কথা বলতে পারেন। সেখানে কবর বলতে আদর্শের কিংবা কর্মপরিকল্পনার চূড়ান্ত বিলুপ্তি বোঝানো হয়। ব্যক্তি আক্রমণ থাকে না।

কিন্তু রাজশাহীতে যে মুহূর্তে বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠানোর কথা বলেন, তখন সেটা আর আদর্শিক কিংবা কর্মকাণ্ডের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে এমন ভাষাকে অত্যন্ত অপরাধজনক হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতেই পারে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন একটি দলের প্রধান এবং সেই দলটি গ্রাম-ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত তাই গোটা দেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। এবং হয়েছেও। রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ এমন হুমকি দেয়ার পর সারা দেশে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। এমনটা হওয়া স্বাভাবিকও বটে।

শেখ হাসিনার প্রতি এমন আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহারকে হত্যার হুমকি হিসেবে তার কর্মী অনুসারীদের মনে করার যৌক্তিক কারণও আছে। কারণ আওয়ামী লীগের নেত্রীর জীবন সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ, এটা এ দেশের ঘাতকদের হত্যাচেষ্টা থেকে প্রমাণিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল মূলত বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশে। ভাগ্যগুণে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন বিদেশে থাকার কারণে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে আসার পরও খুনিদের খুনের নেশা কাটেনি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টি ওই বছরই শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এরপর থেকে ২১বার তাকে হত্যাচেষ্টা করে জঙ্গি গোষ্ঠী ও দুর্বৃত্তরা। এর পেছনে রাজনৈতিক শক্তির মদদ আছে এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এমনকি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম অভিযুক্ত ব্যক্তি তারেক রহমান বর্তমান বিএনপির কার্যকর প্রধান ব্যক্তি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির একজন নেতা যখন প্রধানমন্ত্রীকে কবরস্থানে পাঠানোর কথা বলেন, তাকে সরলভাবে দেখার সুযোগ কম।

সাধারণত দলীয় কোনো নেতা অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য দেয়ার পর দলগতভাবে তাকে অস্বীকার করা হয়। এমন উদাহরণ অনেক সময়ই দেখা যায়। এটা দলের কোনো সিনিয়র নেতাও যদি বলেন তখনও এমন শোনা যায়- এই নেতা যা বলেছেন তা তার ব্যক্তিগত অভিমত, দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। কখনো এমনও বলা হয় ওই নেতার বক্তব্যের দায় দল বহন করবে না। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার বক্তব্যকেও তাদের সংগঠন দলীয় মন্তব্য নয় বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বহুবার।

কিন্তু রাজশাহীতে দেয়া আবু সাঈদ চাঁদের অনাকাঙ্ক্ষিত এই বক্তব্যের পর বিএনপি নীরব ভূমিকা পালন করে আছে। অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটুকু বলা যায়, উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়তো তাদের কোনো নেতা বলবেন, এটা স্লিপ অব টাং। তাও এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করেননি। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখার পর স্পষ্টত মনে হয় চাঁদের বক্তব্য স্লিপ অব টাং নয়। কারণ তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে দুবার কবরে পাঠানোর বক্তব্যটি দিয়েছেন। যার অর্থ দাঁড়ায় বিএনপি আবু সাঈদ চাঁদের বক্তব্যকে ধারণ করছে।

আরও সরলভাবে বললে, আবু সাঈদ চাঁদ যা বলেছেন তা বিএনপিরও বক্তব্য। পুঠিয়ায় যে সমাবেশে চাঁদ বক্তব্য রেখেছিলেন, সেখানে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জাহানারা বেগমও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। জাহানারা বেগম স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। ওই সমাবেশে তিনিও নীরবতা পালন করে প্রকারান্তরে চাঁদের বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। কারণ ওই ঘটনার সংবাদগুলোতে এই বিষয়ে জাহানার বেগমের কোনো মন্তব্য দেখা যায় না। সঙ্গতভাবেই যে কেউ মনে করতে পারেন, বিএনপি চাইছে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক দেশে। যে আশঙ্কা করছে আওয়ামী লীগ। এবং তারা প্রায়ই বলে, বিএনপি দেশে ২০১৪ সালের পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।

রাজনীতিতে আক্রমণ হবে রাজনৈতিকভাবে। এটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অলংকার। যাকে বিতর্ক হিসেবে সাধারণ মানুষ বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু ‘এই তোমার বাড়ি কি গোপালগঞ্জ, তুমি কি গোপালী। গোপালগঞ্জ নামই বিলুপ্ত করে দেবো।’ ইত্যকার বাক্য যখন শোনা যায়, তখন মনে হওয়া যৌক্তিক যে স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের পথেই হাঁটছেন।

অন্যদিকে সেই ভাষা যখন স্থায়ী কমিটির সদস্যের উপস্থিতিতে উচ্চারিত হয় এবং সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রের উপস্থিতিতে যখন বলা হয় এবং উভয় সিনিয়র নেতাই যখন নীরবতা পালন করেন তখন আর তাকে ব্যক্তির বক্তব্য হিসেবেও আখ্যায়িত করার সুযোগ থাকে না।

শালীনতা রাজনীতিবিদদেরই শুধু নয় যে কাউকেই মর্যাদাবান করে, অশ্লীলতা হিংস্রতা কখনো মানুষের সহানুভূতি পায় না। যদি কেউ মনে করে তার অস্বাভাবিক হুমকিতে -প্রতিপক্ষ ভীত হবে, তাহলে তার মেধাসংকট আছে বলেই মনে করতে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রযোজ্য বিষয়টি।

এ প্রসঙ্গে প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি নিবন্ধের অংশবিশেষ স্মৃতি থেকে উল্লেখ করতে চাই। বিষয়টি সরাসরি ভাষাকেন্দ্রিক না হলেও প্রকারান্তরে ভাষার ব্যবহারকারীদের উপকারে আসতে পারে। সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা নিবন্ধের শুরুতেই ছিল পাকিস্তানের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনের ভারত ভ্রমণের কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর আমন্ত্রণে মালিক সাহেব দিল্লি গিয়েছিলেন। বিমান থেকে নামার সময় মালিকপত্নী ভিকারুননিসা নূনের পায়ের স্যান্ডেল পড়ে গিয়েছিল নিচে। সেই স্যান্ডেল নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন নেহেরু এবং ভিকারুননিসা নূনের পায়ের কাছে রেখেছিলেন যাতে তিনি সহজেই পরতে পারেন।

একজন প্রধানমন্ত্রী অতিথির স্যান্ডেল হাতে নিয়ে যা দেখিয়ে গেছেন তা বোধ করি আমাদের রাজনীতিবিদদের শেখা হয়নি। যদি হতো তাহলে সংসদ অধিবেশনের মতো জায়গায় মারমুখী দৃশ্য আমাদের দেখা লাগতো না। কোনো ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হারানোর কারণে সহানুভূতি জানাতে গেলে তার সামনে দরজা বন্ধ করে দেয়া হতো না। একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে রুক্ষ আচরণ করতেন না।

আওয়ামী লীগ বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছে বিএনপি দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছে। বিএনপি নেতার এমন বক্তব্য কি সেই বক্তব্যেরই প্রামাণ্য উদাহরণ?

সর্বশেষ
জনপ্রিয়